যুক্তি নয়, আস্তিকবাদীগণ বিশ্বাসকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তাই বলেন, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর”। মূলগতভাবে আস্তিকগণ ঈশ্বর ধর্ম প্রসঙ্গে মস্তিষ্ক-অলস মানুষ, তাঁরা এসব ব্যাপারে যুক্তিতর্ক করে বহুদূর যেতে পছন্দ করেন না। চোখ বন্ধ রেখে ইমাজিন করে নিতে ভালোবাসেন নিজের মতো করে। তারপর সেটাকেই ফ্রেমবন্দি করে ধ্রুবসত্য বলে প্রচার করবেন। কারণ যুক্তিতর্ক করে বহুদূর যেতে হলে মস্তিষ্ককে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে হয় –প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষণ। তদুপরি আরও বলা যায়, বিশ্বাস কখনো একা একা পথ চলে না, বগলদাবা করে বয়ে নিয়ে বেড়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকেও। তাই বিশ্বাসের কথা বলতে গেলে পাশাপাশি অবধারিতভাবে ধর্মের কথাও এসে পড়ে। বিশ্বাস এবং ধর্ম অনেকসময়ই খুব পরিপূরক, অনেক সময় কেন–সবসময়ই। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে সেখানে জাদুটোনা থেকে শুরু করে নরবলি, কুমারী হত্যা সহ হাজারো অপবিশ্বাসের সমাহার। সেদিক থেকে চিন্তা করলে নাস্তিকতা, যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমস্কতা, লিবারেলিজম প্রভৃতি উপাদানগুলি বিবর্তনীয় প্রেক্ষাপটে মানবসমাজের জন্য অত্যাবশ্যক সংযোজন।
গবেষণায় দেখা গেছে, অবিশ্বাসীরা স্মার্ট শুধু নয়, নৈতিক দিক দিয়েও অবিশ্বাসীরা বিশ্বাসীদের চেয়ে অনেক অগ্রগামী। সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রতি সচেতনতাও বিশ্বাসীদের তুলনায় নাস্তিকদের মধ্যে অনেক বেশি। কারণ অবিশ্বাসীরা সাধারণত বৈজ্ঞানিক যুক্তি, মানবতা এবং বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বিষয়গুলি বিবেচনা করেন, কোনো অন্ধবিশ্বাসের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নয়। বিশ্বাস শুধু মানসিকভাবেই ব্যক্তিকে পঙ্গু এবং ভাইরাস আক্রান্ত করে ফেলে না, পাশাপাশি এর সার্বিক প্রভাব পড়ে একটি দেশের সামাজিক কাঠামোয়, রাষ্ট্রব্যবস্থায় এবং তদুপরি অর্থনীতিতেও। সাম্প্রতিক বহু গবেষণাতেই বেরিয়ে এসেছে যে দারিদ্রের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে। যেসব দেশ যত দারিদ্রক্লিষ্ট, সেসব দেশেই ধর্ম নিয়ে বেশি নাচানাচি হয়, আর শাসকেরাও সেসব দেশে ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। সেজন্যই দারিদ্রক্লিষ্ট তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্ম খুব বড়ো একটা নিয়মক হয়ে কাজ করে থাকে, সবসময়েই। কিংবা ব্যাপারটাকে যদি উলটো করেও দেখি তাহলে দেখব–ধর্মকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেওয়া, কিংবা লম্ফঝম্ফ করা, কিংবা জাগতিক বিষয়-আশয়ের চেয়ে ধর্মকে মাত্রাতিরিক্ত বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই সে সমস্ত দেশগুলি প্রযুক্তি, জ্ঞানবিজ্ঞানে পশ্চাৎগামী এবং সর্বোপরি দরিদ্র।
বিশ্বাস একটা একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ এবং অনুভূতির বিষয়। মানুষ বিশ্বাস তখনই করে, যখন ধারণাকে প্রমাণ করতে পারে না বা প্রমাণ করতে চায় না। মনে করেন আমি বললাম যে আমার কাছে কোনো টাকা নেই এবং আপনি চাইলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আপনি যদি পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে পরীক্ষার পর এটা প্রমাণ হয়ে যাবে আমার কাছে টাকা আছে কি নেই, বিশ্বাসের আর কিছু নেই। আর যদি বিশ্বাস করেন, তার পিছনে যত কারণই থাক না-কেন ফাঁকির একটা সম্ভাবনা থেকেই যাবে। আজকাল শিক্ষিত মানুষগণ চোখের গঠন, নাকের গঠন মার্কা ভুয়া যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে ‘ঈশ্বর’ আছে। তাঁরা এটা বোঝেন না যে যখন তাঁরা বলে তাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, এই বিশ্বাস শব্দটাই প্রমাণ করে যে তাঁদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই এবং এই বিশ্বাসটা সত্যি না-হওয়ারও একটা সম্ভাবনা সবসময়ই আছে। এই ফাঁকির সম্ভাবনাটা গ্রহণ করার অক্ষমতাটার কারণেই বিশ্বাস হয়ে যায় অন্ধবিশ্বাস। এবং এই অন্ধবিশ্বাসই তাঁদের বানিয়ে দেয় ধর্মান্ধ।
বিশ্বাসের আর-একটা ব্যাপার হল আপনি বিশ্বাস না-করেও বলতে পারেন যে আপনি বিশ্বাস করেন। আপনি চাইলে একই সঙ্গে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দুটোই করতে পারেন। যখন আমি বলেছি যে আমার কাছে কোনো টাকা নেই এবং আপনি চাইলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন, আপনি হয়তো ভদ্রতা করে পরীক্ষা করলেন না। এই ক্ষেত্রে আপনি বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দুটোই একই সঙ্গে করতে পারেন। আপনার মস্তিষ্কের একটা অংশ বিশ্বাস করতে পারে আমার কাছে টাকা নেই, পাশাপাশি আপনারই মস্তিষ্কের আর-একটা অংশ বিশ্বাস করতে পারে যে আমার কাছে টাকা আছে, আমি শেয়ার করব না। এই ব্যপারটা স্বাভাবিক। যেটা স্বাভাবিক না সেটা হচ্ছে আপনি যখন পুরোপুরি বিশ্বাস না-করে বলেন বিশ্বাস করেন। এটা হচ্ছে নিজের সাথে প্রতারণা, ভণ্ডামির উৎস।
পৃথিবীতে প্রচলিত সমস্ত ধর্মগুলোর সত্যিই কি কোনো ভিত্তি আছে? যেখানে জন্মসূত্রে আমরা ধর্মগুলোকে পাই সেখানে ঈশ্বর মনোনীত ধর্ম পাওয়া সেফ ওই ঈশ্বর মনোনীত ধর্মের একজন পুরুষের সন্তান উৎপাদনের সঙ্গে যোগসূত্র। একজন হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ আর ইহুদি হওয়ার মধ্যে জন্মসূত্রই প্রধান। মহান ঈশ্বরের মনোনীত ধর্মের ডাকে সাড়া দেওয়ার অন্য কোনো উপায় নেই। ধর্মগ্রন্থের ধর্মবিধান মানুষ দ্বারাই সৃষ্ট। প্রাচীনকালে এই ধর্মগ্রন্থই ছিল অনুশাসনের জন্য একমাত্র সংবিধান। ধর্মগ্রন্থের উপর ভিত্তি করেই চলত দেশশাসন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি অপৌরুষেয় তথা ঈশ্বরপ্রেরিত দূত দ্বারা প্রেরণ করা হয়েছে বলে যে গল্প শোনানো হয়, তা অমূলক নয়। সেসময়ের ধর্মীয় নেতা তথা শাসকগণ অনুশাসনের গ্রন্থগুলি রচনা করে অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। না-হলে সমাজে সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হত না। মানুষ চরম উদ্ধৃঙ্খল হয়ে পড়ত। এক অরাজকতার পরিস্থিতি বিরাজ করত সমগ্র পৃথিবীতে। চলত হানাহানি, খুনোখুনি। সভ্যতার বিকাশের ও বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এক সুসংগঠিত রাষ্ট্রের সৃষ্টি হল। রচিত হল শাসনতন্ত্রের সুদৃঢ় এবং আধুনিক সংবিধান। এই অনুশাসনে কোনো ধর্ম নেই, ঈশ্বর নেই। ঈশ্বরের আশীর্বাদ নেই, অভিসম্পাত নেই। অলৌকিক স্বর্গের সুখ, নরকের যন্ত্রণার কথা বলা হয়নি। বেদ, মনুসংহিতা, কোরান, হাদিস, বাইবেল, ত্রিপিটক–এসব গ্রন্থগুলির অনুশাসনগুলি আজ খুবই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ধর্মের অনুশাসন এবং রাষ্ট্রের অনুশাসন দুটোই একসঙ্গে চলতে পারে না। ধর্মের বিধান নয়, রাষ্ট্রের পেনাল কোডই গ্রহণযোগ্য। ধর্মীয় অনুশাসন বর্বরোচিত, অমানবিক, বিভেদকামী, দুষ্পরিবর্তনীয়–যা আজকের দিনে সম্পূর্ণভাবে অচল। রাষ্ট্রের আইনব্যস্থা যখন যথেষ্ট সম্পূর্ণ, তখন সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন অবাঞ্ছিতই!