(৫) প্রাচীন মায়া সভ্যতায় নরবলি প্রথা প্রচলিত ছিল। অদৃশ্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষের মাথা কেটে ফেলে, হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলে, অন্ধকূপে ঠেলে ফেলে হত্যা করা হত। ১৪৪৭ সালে গ্রেট পিরামিড অব টেনোখটিটলান তৈরির সময় চারদিনে প্রায় ৮০,৪০০ বন্দিকে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা হয়েছিল। শুধু মায়া সভ্যতাতেই নয়, সারা পৃথিবীতেই এ ধরনের উদাহরণ আছে। পেরুতে প্রি-ইনকা উপজাতিরা ‘হাউস অব দ্য মুন’ মন্দিরে শিশুদের হত্যা করত। তিব্বতে বন শামানেরা ধর্মীয় রীতির কারণে মানুষ হত্যা করত। বোর্নিওতে বাড়ির ইমারত বানানোর আগে প্রথম গাঁথুনিটা এক কুমারীর দেহ দিয়ে প্রবেশ করানো হত “ভূমিদেবতা’-কে তুষ্ট করার খাতিরে।
(৬) প্রাচীন ভারতে দ্রাবিড়রা গ্রামের ঈশ্বরের নামে মানুষ উৎসর্গ করত। কালিভক্তরা প্রতি শুক্রবারে শিশুবলি দিত।
(৭) তৃতীয় ক্রুসেড়ে রিচার্ডের আদেশে তিন হাজার বন্দিকে–যাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী এবং শিশু–জবাই করে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় ক্রুসেডের সময় সেন্ট বার্নাড ফতোয়া দিয়েছিলেন–“প্যাগানদের হত্যার মাধ্যমেই খ্রিস্টানদের মাহাত্ম সূচিত হবে। আর জিশুখ্রিস্ট নিজেও এতে মহিমান্বিত হবেন।”
(৮) ইসমাইলি শিয়া মুসলিমদের একটি অংশ একসময় লুকিয়ে ছাপিয়ে বিধর্মী প্রতিপক্ষদের হত্যা করত। এগারো থেকে তেরো শতক পর্যন্ত আধুনিক ইরান, ইরাকএবং সিরিয়ায় বহু নেতা তাঁদের হাতে প্রাণ হারায়। শেষপর্যন্ত ইতিহাসের আর-এক দস্যুদল মোঙ্গলদের হাতে তাঁদের উচ্ছেদ ঘটে –কিন্তু তাঁদের বীভৎস কীর্তি আজও অম্লান।
(৯) কথিত আছে, এগারো শতকের শুরুর দিকে ইহুদিরা খ্রিস্টান শিশুদের ধরে নিয়ে যেত, তারপর উৎসর্গ করে তাদের রক্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার করত। এই রক্তের মহাকাব্য রচিত হয়েছে এমনি ধরনের শত সহস্র অমানবিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে।
(১০) ১২০৯ সালে পোপ তৃতীয় ইনসেন্ট উত্তর ফ্রান্সের আলবিজেনসীয় খ্রিস্টানদের উপর আক্ষরিক অর্থেই ক্রুসেড চালিয়েছিলেন। শহর দখল করার পর যখন সৈন্যরা ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে পরামর্শ চেয়েছিল কীভাবে বন্দিদের মধ্যে থেকে বিশ্বাসী এবং অধার্মিকদের মধ্যে পার্থক্য করা যাবে। পোপ তখন আদেশ দিয়েছিলেন–“সবাইকে হত্যা কর”। পোপের আদেশে প্রায় বিশ হাজার বন্দিকে চোখ বন্ধ করে ঘোড়ার পিছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে ছ্যাঁচরাতে ছ্যাঁচরাতে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়।
(১১) মুসলিমদের পবিত্র যুদ্ধ ‘জিহাদ’ উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে স্পেন পর্যন্ত রক্তাক্ত করে তোলে। তারপর এই জিহাদের মড়ক প্রবেশ করে ভারতে–আর তারপর চলে যায় বলকান (ক্যাথলিক ক্রোয়েশিয়ান, অর্থডক্স সার্ব এবং মুসলিম বসনিয়ান এবং কসোভো) থেকে অস্ট্রিয়া পর্যন্ত।
(১২) বারো শতকের দিকে ইনকারা পেরুতে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে, যে সাম্রাজ্যের পুরোধা ছিলেন একদল পুরোহিত। তাঁরা ঈশ্বর কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ২০০ শিশুকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে।
(১৩) ১২১৫ সালের দিকে চতুর্থ ল্যাটেরিয়ান কাউন্সিল ঘোষণা করে তাঁদের বিস্কুটগুলো (host wafer) নাকি অলৌকিকভাবে জিশুর দেহে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। এরপর একটি গুজব রটিয়ে দেওয়া হয় যে, ইহুদিরা নাকি সেসব পবিত্র বিস্কুট চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এই গুজবের উপর ভিত্তি করে ১২৪৩ সালের দিকে অসংখ্য ইহুদিদের জার্মানিতে হত্যা করা হয়। একটি রিপোর্টে দেখা যায় ছয় মাসে ১৪৬ জন ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল। এই পবিত্র হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে প্রায় ১৮ শতক পর্যন্ত।
(১৪) বারো শতকের দিকে সাড়া ইউরোপ জুড়ে আলবেজেনসীয় ধর্মদ্রোহীদের খুঁজে খুঁজে হত্যার রীতি চালু হয়। ধর্মদ্রোহীদের কখনো পুড়িয়ে, কখনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে কখনো-বা শিরোচ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। পোপ চতুর্থ ইনোসেন্ট এই সমস্ত হত্যায় প্রত্যক্ষ ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। কথিত আছে ধর্মবিচরণ সভার সংবীক্ষক (Inquisitor) রবার্ট লি বোর্জে এক সপ্তাহে ১৮৩ জন ধর্মদ্রোহীকে হত্যার জন্য পাঠিয়েছিলেন।
(১৫) বহু লোক সে সময় নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ধর্মত্যাগ করেন, কিন্তু সে সমস্ত ধর্মত্যাগীদের পুরোনো ধর্মের অবমাননার অজুহাতে হত্যার আদেশ দেওয়া হয়। স্পেনে প্রায় ২০০০ ধর্মত্যাগীদের পুড়িয়ে মারা হয়। কেউ কেউ ধর্মত্যাগ না-করলেও ধর্মের অবমাননার অজুহাতে পোড়ানো হয়। জিওর্দানো ব্রুনোর মতো দার্শনিককে বাইবেল-বিরোধী কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব সমর্থন করার অপরাধে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয় সে সময়।
(১৬) ইতিহাস খ্যাত ‘ব্ল্যাক ডেথ’ যখন সাড়া ইউরোপে ১৩৪৮-১৩৪৯ এ ছড়িয়ে পড়েছিল, গুজব ছড়ানো হয়েছিল এই বলে যে, ইহুদিরা কুয়ার জল কিছু মিশিয়ে বিষাক্ত করে দেওয়ায় এমনটি ঘটছে। বহু ইহুদিকে এ সময় সন্দেহের বশে জবাই করে হত্যা করা হয়। জার্মানিতে পোড়ানো দেহগুলোকে স্তূপ করে মদের বড়ো বড়ো বাক্সে ভরে ফেলা হয় এবং রাইন নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। উত্তর জার্মানিতে ইহুদিদের ছোট্ট কুঠুরিতে গাদাগাদি করে রাখা হয় যেন তাঁরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়, কখনো-বা তাঁদের পিঠে চাবুক কষা হয়। থারিঞ্জিয়ার যুবরাজ জনসমক্ষে ঘোষণা করেন যে, তিনি তাঁর ইহুদি ভৃত্যকে ঈশ্বরের নামে হত্যা করেছেন; অন্যদেরকেও তিনি একই কাজে উৎসাহিত করেন।