রামচন্দ্র ছত্রপতি সাংবাদিক ও সমাজকর্মী। তিনি ধর্ষক বাবা গুরমিত রাম রহিম সিংয়ের ঘটনা প্রথম সামনে আনেন তাঁর পত্রিকা ‘পুরা সচ’-এ। সেখানে দুই সাধ্বীর গোপন জবানবন্দি ছাপেন তিনি। যার ভিত্তিতে পরে সাজা পেয়েছে ধর্ষক রাম রহিম। তবে সেই ঘটনার এক মাসের মধ্যেই ২০০২ সালের ২১ নভেম্বর উগ্র আস্তিক্যবাদীদের গুলিতে খুন হন তিনি। নরেন্দ্র দাভোলকর পেশায় চিকিৎসক হলেও দুনিয়া তাঁকে চেনে বিশিষ্ট সমাজকর্মী হিসাবে। মহারাষ্ট্রের এই মানুষটি কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভৌতিক জাদুর বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট খুন হন উগ্র আস্তিক্যবাদীদের হাতে। পরের বছর সমাজসেবায় অনবদ্য অবদানের জন্য তাঁকে মরণোত্তর ‘পদ্মশ্রী সম্মান দেওয়া হয়। দাভোলকরের মৃত্যুর কয়েকদিনের মধ্যে কুসংস্কার ও কালাজাদু সম্পর্কিত অর্ডিন্যান্স পাস করে মহারাষ্ট্র সরকার। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে নিহত হন সাহিত্য আকাঁদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সমাজকর্মী এম এম কালবুর্গি। হাম্পি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য কালবুর্গি লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের মানুষ। মূর্তিপুজো ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। কর্ণাটকের ধারওয়াড়ে তাঁর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে খুন করে উগ্র আস্তিক্যবাদীরা। বামপন্থী নেতা গোবিন্দ পানসারে ২০১৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নিহত হন। তাঁদের বাড়িতে ঢুকে তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে আক্রমণ করে উগ্র আস্তিক্যবাদীরা। ৫টি গুলি লেগেছিল গোবিন্দ পানসারের শরীরে। তিনি হাসপাতালে মারা যান। পানসার উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতায় সরব ছিলেন। নাথুরাম গডসের সমালোচনা করেছিলেন। কোলাপুরে টোল ট্যাক্সেরও বিরোধিতায় আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এম এম কালবুর্গি, নরেন্দ্র দাভোলকর এবং গোবিন্দ পানসারেকে গুলি করে খুন করেছিল উগ্র আস্তিক্যবাদীরা। তিনজনের খুনের কিনারা হয়নি এখনও। একই অস্ত্রে খুন হলেন নির্ভীক সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ। মঙ্গলবার রাতে বাড়ির সামনে উগ্র আস্তিক্যবাদীরা তাঁকে গুলি করে খুন করেছে। ২০১৩ সালের আগস্ট থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর। ৪ বছরের মধ্যে নির্ভীক চার জন মানুষ খুন হয়েছেন। ঘটনাস্থল আলাদা হলেও তাঁদের খুন করার ধরন একইরকম। সকলকেই গুলি করে খুন করা হয়েছে। উগ্র আস্তিক্যবাদীরা এসেছিল মোটরবাইকে চড়ে। ৪টি খুনের ঘটনার সাদৃশ্য ধরা পড়েছে কর্নাটকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রামলিঙ্গ রেড্ডি এবং ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহর চোখে। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে এম এম কালবুর্গিকে হত্যার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল ৭.৬৫ এম এম পিস্তল। একই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে দাড়োলকর ও পানসারকেও খুন করা হয়। এইসব উগ্র আস্তিক্যবাদীদের ধর্ম-পরিচয় কী? কী যায় আসে এঁদের। ধর্ম-পরিচয়ে? এঁরা কেউ হিন্দু কেউ মুসলিম বটে, ধর্ম-পরিচয়ে। আসলে উগ্র আস্তিক্যবাদীরা ধর্ম-নির্বিশেষে একই মুদ্রার এপিঠ আর ও-পিঠ। মৌলবাদীর শিকড় এক জায়গাতেই মিশে আছে। এঁরা কেউ পৃথক নয়। এঁরা একে অপরকে কখনোই হত্যা করে না। এঁরা উভয়েই হত্যা করে যুক্তিবাদী নাস্তিকদের। এই একটি ভাবনায় উভয় গোষ্ঠী গলায় গলায় গলাগলি আর কোলাকুলি।
শুধু প্রতিবাদ নয়, এইসব আততায়ীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে ধর্ম-নির্বিশেষে। ফিরিয়ে দিতে হবে প্রত্যাঘাত। গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ আত্মরক্ষার অধিকারে। মৌলবাদে কোনো দেশ নেই, ধর্ম নেই, জাতি নেই। ওরা দুর্বল ভাবে, নিরস্ত্রের সুযোগ নিয়ে সশস্ত্র হামলাতে করে। আত্মরক্ষার সবরকমের প্রস্তুতি নিয়ে থাকুন। এইভাবে উগ্র আস্তিকদের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের লড়াই জারি রাখতে হবে। উগ্র আস্তিকদের কাছে আমার একটাই বিনম্র আবেদন, নাস্তিকদের হত্যা করে নাস্তিক্যবাদকে হত্যা করতে পারবেন না নাস্তিক্যবাদ ছিল, আছে এবং থাকবে। পৃথিবীতে ১০০ কোটির বেশি নাস্তিককে হত্যা করতে করতে আপনারা হাঁফিয়ে উঠবেন, তবুও নাস্তিক্যবাদ থাকবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি/সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?”
আস্তিক্যবাদীরা নিজেদের মত ও পথকে বিশ্বাসের প্রাধান্য দিয়ে রক্তপাতে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করেন। আস্তিকবন্ধুগণ রাগ করবেন না। ইতিহাস তো আমি সৃষ্টি করিনি। সেই ইতিহাসের সালতামামি যুক্তিবাদী অভিজিৎ রায়ের কলমে—
(১) প্রথম ক্রুসেড সংঘটিত হয়েছিল ১০৯৫ সালে। সে সময় Deus Vult (ঈশ্বরের ইচ্ছা) ধ্বনি দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে জার্মানির রাইন ভ্যালিতে হত্যা করা হয় এবং বাস্তুচ্যুত করা হয়। জেরুজালেমের প্রায় প্রতিটি অধিবাসীকে হত্যা করা হয় শহর ‘পবিত্র’ করার নামে।
(২) দ্বিতীয় ক্রুসেড পরিচালনার সময় সেন্ট বার্নার্ড ফতোয়া দেন, “প্যাগানদের হত্যার মাধ্যমেই খ্রিস্টানদের গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব।”
(৩) প্রাচীন আরবে ‘জামালের যুদ্ধে প্রায় দশ হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিল, তাঁদের আপন জ্ঞাতিভাই মুসলিমদের দ্বারাই। ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মোহম্মদ নিজেও বনি কুরাইজার ৭০০ বন্দিকে একসঙ্গে হত্যা করেছিলেন বলে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।
(৪) বাইবেল থেকে (O.T. ৩১ : ১৬-১৭) জানা যায়, মুসা প্রায় এক লক্ষ পুরুষ এবং আটষট্টি হাজার রমণীকে হত্যা করেছিলেন।