যুক্তিবাদী কৌশিক তাঁর “ধর্ম, একটি সামাজিক ব্যাধি” প্রবন্ধে এই উন্মাদনা বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন, “সেটা কী ধরনের উন্মাদনা? সবচেয়ে বিষাক্ত, ক্ষতিকারক এবং ছোঁয়াচে ধরনের। যে উন্মাদনা কোনো যুক্তি মানে না, সাধারণ বুদ্ধি মানে না; যে উন্মাদনা নির্ভরশীল একটি অদৃশ্য, অলীক, অনুপস্থিত, কল্পনাপ্রসূত ব্যক্তি বা বস্তুবিশেষ বা এনটিটি-র উপরে; যে উন্মাদনার দৃঢ় ধারণা যে, সেই এনটিটি মানুষের কথা চিন্তা করে সমস্ত সৃষ্টির ইতিকথা লিখে গেছে কয়েকশ পাতার ধর্মপুস্তকের মধ্যে–এবং সেই অযাচিত ঐশী বাক্যসমূহ অক্ষরে অক্ষরে সত্য; যদিও তাদের উৎস বা প্রোভেনেন্স পরীক্ষা করতে গেলে অনেক রকম গণ্ডগোল ধরা পড়ে; যদিও অনেক সময়ই প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্মপুস্তকটি অনুবাদের সংস্করণ অনুযায়ী বিভিন্ন রকম কথা বলে থাকে। এ হল সেই উন্মাদনা, যার বশবর্তী হয়ে একদল মানুষ নিশ্চিন্তে, নিশ্রুপে তাঁদের জীবনের সম্পূর্ণ দখল বা কন্ট্রোল তুলে দেয় এক বা একাধিক অন্য মানুষের হাতে, যাঁরা নিজেদের ধর্মগুরু বা আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে আখ্যা দিয়ে থাকে এবং সেইসব ধর্মীয় নেতার অঙ্গুলিহেলনে বা মুখের একটা কথায় তাঁরা মানবত্বকে শিকেয় তুলে যুক্তি-বুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে নেমে পড়ে ঘৃণ্য, জঘন্য, হীন, পাশবিক আচরণ করতে। আর সেইসব আচরণে যোগদান করাটা খুবই সহজ, কারণ ধর্মের ছায়া থাকতে কাউকে তো নিজের কোনো কাজের দায়িত্ব বা রেসপন্সিবিলিটি বহন করতে হয় না। ওই যে, আইনে একটা সুন্দর অজুহাত আছে–স্বল্প সাময়িক উন্মত্ততা, টেম্পোরারি ইনস্যানিটি; ধর্মের ক্ষেত্রে খুবই উপযোগী”।
ইতিহাস ঘেঁটে আস্তিকদের কতটুকু অবদান উদ্ধার করা যায় দেখা যাক। প্লেটোর প্রায় সমকালে ভেসেক্রিটাস ও এপিকুরাস, নাস্তিক্যবাদের সমর্থনে যুক্তিবিন্যাস করেছিলেন। খ্রিস্ট্রজন্মের ৫০০ বছর আগে পিথাগোরাস, এনাকু সিমেন্ডের মতো মনস্বীরা জানিয়েছিলেন, পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ। সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী ও অন্য গ্রহগুলি ঘুরছে। এই অপরাধে তাঁদের ভোগ করতে হয়েছিল অশেষ অত্যাচার, নির্যাতন। কারা করেছিল এই অত্যাচার? মৌলবাদী আস্তিকরা। এরপর তাঁদের মতকে ২০০০ বছর পরে গ্রন্থাগারে তুলে ধরলেন পোল্যান্ডের নিকোলাস কোপারনিকাস। তাঁরই উত্তরসূরি ইতালির জিয়োর্দানো ব্রুনো এবং গ্যালিলিও গ্যালিলি। ব্রুনোকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয় এবং গ্যালিলিওকে জীবনের শেষ আটটি বছর বন্দিশালায় কাটাতে হয়েছিল। কারা করেছিল এইসব কাণ্ড? মৌলবাদী আস্তিকরা। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস হেমলক বিষপান করিয়ে আত্মহত্যা করানো হয়েছিল। কারা করেছিল এইসব কাণ্ড? মৌলবাদী আস্তিকরা। আস্তিক মৌলবাদীরা কি ফিরিয়ে দিতে পারবেন। এইসব মহামানবদের জীবন? এখন বলুন আপনারা সক্রেটিস, ব্রুনো, গ্যালিলিওরা কি ভুল ছিল?
খ্রিস্টজন্মের প্রায় ৪০০ বছর আগে অ্যানাকসাগোরাস বলেছিলাম–চন্দ্রের নিজের কোনো আলো নেই। চন্দ্রগ্রহণের কারণও তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন। এহেন ‘অপরাধ’-এর জন্য তাঁকে দেশ থেকে বিতারিত করা হয়েছিল। যোড়শ শতকে সুইজারল্যান্ডে রসায়নবিদ্যার অধ্যাপক প্যারাসেলসাস ঘোষণা করেন মানুষের অসুস্থতার কারণ কোনো পাপের ফল বা অশুভ শক্তি নয়, রোগের জীবাণু। একথা শুনে ধর্মধ্বজীরা আস্তিকরা ক্ষুব্ধ হন এবং তাঁর প্রাণদণ্ড ঘোষণা করেন। তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে কোনোমতে প্রাণ রক্ষা করেন। সেদিন কি প্যারাসেলসাস ভুল তত্ত্ব ঘোষণা করেছিলেন?
এ তো গেল প্রাচীন যুগের কথা। এবার আসি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-নির্ভর আধুনিক যুগের তথাকথিত শিক্ষিত ও সভ্য আস্তিকদের কথা। কিস্যু বদলায়নি। আজও বর্বর যুগ বহমান রেখেছেন তাঁরা। ধর্মকে সমালোচনা, ধর্মকে প্রশ্ন করা ও ধর্মে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলিকে ধরা মৌলবাদী আস্তিকরা আজও পছন্দ করেন না। সে পছন্দ না-ই করতে পারেন। তাই বলে বর্বরোচিত আচরণ। অপছন্দের মানুষদের সঙ্গে! বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখিকা ও চিকিৎসক তসলিমা নাসরিনকে ধর্মের বিরুদ্ধে কলম ধরার অপরাধে উগ্র আস্তিক্যবাদীরা তাঁর মুণ্ডচ্ছেদের ফতোয়া জারি করে দিল ১৯৯৪ সালে। তসলিমা দেশ ত্যাগ পালিয়ে বেঁচেছেন। আজ দীর্ঘ ২৭ বছর তিনি নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। ১৯৮৮ সালে “The Satanic Verses গ্রন্থটি লেখার অপরাধে লেখক সলমন রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যদণ্ডের ফতোয়া জারি করেন ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা খোমেইনি। অভিযোগ ছিল ‘The Satanic Verses’ গ্রন্থটি আস্তিক মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করছিল। বাংলাদেশের যুক্তিবাদী, নাস্তিক্যবাদী ও মুক্তমনা লেখক রাজীব হায়দার ওরফে থাবা বাবাকে হত্যা করেছিল উগ্র আস্তিক্যবাদীরা। অভিযোগ, তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে আস্তিক মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করছিল। বাংলাদেশের যুক্তিবাদী মনোজ্ঞ লেখক ও ‘মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে ২০১৫ সালে হত্যা করে উগ্র আস্তিক্যবাদীরা। ২৬ জানুয়ারি রাত ৮ টা ৩০ মিনিট নাগাদ বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টোদিকের সোহরাওয়ার্দি উদ্যান সংলগ্ন সড়কে আস্তিক্যবাদী আততায়ীদের চাপাতির এলোপাথাড়ি কোপে অভিজিৎ শরীর থেকে মুণ্ড বিচ্ছেদ করা হয়। সঙ্গী তাঁর স্ত্রী বন্যাকেও এলোপাথাড়ি কোপানো হয়। বন্যা মারাত্মভাবে জখম হন। ভারতে প্রখ্যাত কবি শ্রীজাতকে খুনের হুমকি ও অভিনেত্রী সায়নী ঘোষকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয় ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার অভিযোগে। হুমকিদাতারা অবশ্যই উগ্র আস্তিক্যবাদী। সত্য প্রকাশ ও ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার অভিযোগে এম এম কালবুর্গি, নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসার, গৌরী লঙ্কেশ, রামচন্দ্র ছত্রপতিকে খুন হতে হয় উগ্র আস্তিক্যবাদীদের হাতে।