ধর্মগুলোর মধ্যে একটি বড় সাদৃশ্য হল–সকল ধর্মই দাবি করে সেই-ই অভ্রান্ত, সত্য এবং সর্বোৎকৃষ্ট। স্বধর্ম ছাড়া বাকি সব ধর্ম মিথ্যা, ভ্রান্ত এবং খুবই নিকৃষ্ট। সব ধর্মই স্বধর্মাবলম্বীদের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন অনন্ত স্বর্গ, অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য শুধুই নরক। এ কেমন কথা! সত্য তো এক এবং অখণ্ডই হবে–একই সময়ে একই সঙ্গে পরস্পরবিপরীত দুটি কথা সত্য হতে পারে না। অতএব “সকল ধর্মই মানবতার কথা বলে”–এরকম যাঁরা বলেন তাঁরা হয় মানবতা বোঝেন না, নয়তো ধর্ম বোঝেন না। ভুলে গেলে চলবে না, ধর্মগুলো সবটাই বিশ্বাস-নির্ভর। বিশ্বাস মানুষের একান্ত মনের ব্যাপার। অথচ ধর্মগুলো বিশ্বাস মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। কিছু কিছু ধর্মবিশ্বাসীরা ধর্মশাস্ত্রের দাঁতভাঙা হিজিবিজি কথার মধ্যে গভীর তত্ত্বের খোঁজ পান। আবার কেউ কেউ দাবি করেন তাঁদের ধর্মগ্রন্থ সকল বিজ্ঞানের উৎস। কিন্তু কোনো কিছু আবিষ্কারের পরপরই তাঁরা তা ধর্মশাস্ত্রে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন এবং অল্পকাল পরে তা পেয়েও যান এবং তারও কিছু পরে ধর্মশাস্ত্রের কিছু কথার ব্যাখ্যা এমনভাবে দিতে থাকেন যাতে মনে হয় এর আবিষ্কারক ওই ধর্মশাস্ত্রটিই। হাঃ হাঃ হাঃ। কিন্তু আবিষ্কার হওয়ার আগে কেন ওই বিষয়টি ওই ধর্মশাস্ত্রে পাওয়া যায়নি? বস্তুত যে-কোনো ধর্মবিশ্বাসীদের সিংহভাগই তাঁদের ধর্মগ্রন্থের মূল ভাষা জানেন না, অনুবাদের আশ্রয় নিতে হয়। মজার কথা হল, ধর্মবিশ্বাসীরা বুঝে অথবা না-বুঝে তাঁদের নিজ নিজ ভাষায় যতই ধর্মশাস্ত্র চর্চা করে থাকেন, ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা দিয়ে পক্ষ অবলম্বন করেন তাতে কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু যখনই কেউ ধর্মশাস্ত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেন বা সন্দেহ প্রকাশ করেন ঠিক তখনই ধর্মবাদীরা “শাস্ত্র পাঠ করে ঠিকমতো বোঝা হয়নি” ওজর তোলেন।
অন্যের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা খুবই অন্যায়। জ্ঞানত অথবা অজ্ঞানতা যেভাবেই হোক আঘাত করলেই ঘাড় থেকে মুণ্ডু নামিয়ে দেওয়া হবে। দেশের আইনও এই কারণে আঘাতকারীকে শাস্তি-টাস্তি দিয়ে থাকেন। “ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত”টি দেখতে কেমন? পাশের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম নাগরিকরা ইদের সময় গণহারে যে গোরু কোরবানি দেওয়া হয়, তা হিন্দুদের কাছে গোমাতা। এতে কি হিন্দুদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে না! ও-দেশে হিন্দুসমাজের কেউ এ ব্যাপারে মামলা করেছে বলে কোনোদিন শুনিনি। অপরদিকে এই ভারতের অনেক রাজ্যে গোরু জবাই নিষিদ্ধ। সেই রাজ্যের মুসলিমদের কি ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা হয় না? মুসলিমরা কোনোদিন ওজর-আপত্তি তুলেছেন বলে তো শুনিনি। তাহলে ধর্মীয় আঘাত কি শুধুমাত্র একটা বিমূর্ত আবেগ। ছোঁয়া যায় না, কিন্তু কেমন যেন একটা শিরশিরানি হয়! সবটাই নির্ভর করে সংখ্যার উপর। কোন্ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তার উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, হিন্দুরা মিয়মান সংখ্যালঘু। তাই ওদেশে মুসলিমদের ধর্মানুভূতি বেশি। তাই দিনরাত সংখ্যালঘুদের হুমকি দিয়ে চলেছে ধর্মানুভূতিতে। হিন্দুরা মুখ বুজে সহ্য করে টিকে আছে। ভারতে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, মুসলিমরা ক্রমবর্ধমান সংখ্যালঘু। তাই এদেশে সংখ্যাগুরুরা দিনরাত সংখ্যালঘুদের হুমকি দিয়ে চলেছে ধর্মানুভূতিতে। ধর্মানুভূতি কোথায় কারা তীব্র আকার ধারণ করবে, কোথায় কারা ‘বিড়াল তপস্বী’ হয়ে থাকবে, তা নির্ভর করে সংখ্যার উপরে।
মানবসমাজের শুরুতে তো ঈশ্বর ধারণা ছিল না, তারপর কেউ একজন প্রথমে ঈশ্বরের ধারণা নিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে burden of proof পড়ে ঈশ্বরের প্রবক্তার উপর। আইনের ভাষায় “the necessity of proof always lies with the person who lays charges.” সুতরাং, ঈশ্বর যে আছেন তা প্রমাণ করা আস্তিকদের দায়িত্ব, নাস্তিকদের ঈশ্বর নেই এটা প্রমাণ করার দরকার নেই। “না”-এর কোনো প্রমাণ হয় না, “হ্যাঁ” বললে প্রমাণ করতে হবে, হবেই। আপনার ঘরে সিন্দুকের ভিতর ময়ূর সিংহাসনটি আছে বললে ময়ূর সিংহাসনটি হাজির করে প্রমাণ করতে হবে যে ময়ূর সিংহাসনটি সিন্দুকের ভিতর আছে। কিন্তু কেউ যদি বলে সিন্দুকটির ভিতর কোনো ময়ূর সিংহাসন নেই, তাহলে “নেই” প্রমাণ হয় খালি সিন্দুক দেখিয়েই।
ঈশ্বর কেমন? এই প্রশ্নের উত্তর পৃথিবীতে যদি ৫ বিলিয়ন আস্তিক থাকে, তবে দেখা যাবে ঈশ্বরের ৫ বিলিয়ন সংজ্ঞা বাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। আস্তিকগণ হাজার হাজারবছর পার করে দিলেও আজ পর্যন্ত ঈশ্বরের ব্যাখ্যায় একমতে আসতে পারল না। ঈশ্বর কী? ঈশ্বর কেমন?–কোনো প্রশ্নেরই যথাযথ উত্তর দিতে পারেন না। প্রশ্ন করলেই পালটা প্রশ্ন করে পৃথিবীতে দিনরাত হয় কে করেন? এক ফোঁটা বীর্য থেকে কীভাবে কে সন্তান সৃষ্টি করেন? সমুদ্রে জোয়ারভাটার পিছনে কার হাত? ইত্যাদি অবান্তর প্রশ্ন। এসব হেঁদো প্রশ্নের জবাব যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষ তাঁর “আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না” গ্রন্থে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন, পড়ে জেনে নিতে পারে, জেনে জ্ঞানী হতে পারেন।
ধর্ম হল সেই উন্মাদনা, যাকে যেন-তেন-প্রকারেণ উপস্থাপিত করতেই হয় যে সেই-ই শ্রেষ্ঠ, সেই-ই শেষ কথা। তাই বিভিন্ন মানুষের যদি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মানুভূতি থেকে থাকে, ধর্মের ক্রিয়াকলাপ, আচার-ব্যবহার যদি আলাদা হয়ে থাকে, ধর্মের বাণী সম্পর্কে মতামত ভিন্ন হয়ে থাকে, তাহলে তাকে যেভাবেই হোক এক পথে নিয়ে আসতে হবে, এক মতে নিয়ে আসতে হবে–যে-কোনো মূল্যে। অবশ্য ধার্মিক লোকজনের কাছে সাধারণভাবে নিজের ধর্ম ছাড়া আর কোনো কিছুরই কোনো মূল্য নেই। নেই মানুষের মূল্য, নেই সভ্যতার মূল্য, নেই জীবনের মূল্য। আছে শুধু এক সর্বগ্রাসী এবং রক্তক্ষয়ী উন্মাদনা। চোখ-কান খোলা রাখলেই পরিষ্কার প্রত্যক্ষ করতে পারবেন–এই উন্মাদনার উৎপত্তি বেশ সুপরিকল্পিত। কারণ উন্মাদনা থিতিয়ে পড়লেই মানুষ তখন চিন্তা করতে চায়, আর চিন্তা করলেই তো ধর্মের অসারত্ব ধরা পড়ে যাবে। তাই যুগে যুগে ধর্মীয় নেতারা এই উন্মাদনাকে জিইয়ে রাখার আয়োজন করে এসেছে। ভবিষ্যতেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে।