‘নাস্তিক’ শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থটি আমাদের জানা প্রয়োজন। ‘নাস্তিক’ শব্দটি ভাঙলে দাঁড়ায়, নাস্তিক + কন বা নাস্তি + ক। ‘নাস্তি’ শব্দের অর্থ হল নেই, অবিদ্যমান। ‘নাস্তি’ শব্দটি মূল সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসে ‘ক’ বা ‘কন’ প্রত্যয় যোগে নাস্তিক হয়েছে, যা তৎসম শব্দ হিসাবে গৃহীত। ন আস্তিক = নাস্তিক, যা নঞ তৎপুরুষ সমাসে সিদ্ধ এবং আস্তিকের বিপরীত শব্দ। আরও সহজ করে বলা যায়, না + আস্তিক =নাস্তিক। খুবই পরিষ্কার যে, সংগত কারণেই আস্তিকের আগে ‘না’ প্রত্যয় যোগ করে নাস্তিক শব্দটি তৈরি করা হয়েছে। আস্তিকরা যে ঈশ্বর/আল্লাহ/খোদা ইত্যাদি পরমসত্ত্বায় বিশ্বাস করে এ তো সবারই জানা। কাজেই নাস্তিক হচ্ছে তাঁরাই, যাঁরা এই ধরনের বিশ্বাস হতে মুক্ত। তাই সংজ্ঞানুযায়ী নাস্তিকতা কোনো বিশ্বাস নয়, বরং বিশ্বাস থেকে মুক্তি বা ‘বিশ্বাসহীনতা’। ইংরেজিতে নাস্তিকতার প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘Atheist’। সেখানেও আমরা দেখছি “theist” শব্দটির আগে ‘a’ প্রিফিক্সটি জুড়ে দিয়ে Atheist শব্দটি তৈরি করা হয়েছে। নাস্তিকতা এবং মুক্তচিন্তার উপর বহুল প্রচারিত গবেষণাধর্মী একটি ওয়েব সাইটে শব্দটির যে সংজ্ঞা আছে–Atheism is characterized by an absence of belief in the existence of gods. This absence of belief generally comes about either through deliberate choice, or from an inherent inability to believe religious teachings which seem literally incredible. It is not a lack of belief born out of simple ignorance of religious teachings.
সহজেই অনুমেয় যে, “absence of belief” শব্দমালা চয়ন করা হয়েছে। ‘বিশ্বাসহীনতা’কে তুলে ধরতেই, উলটোটি বোঝাতে নয়। Gordon Stein তাঁর বিখ্যাত “An Anthology of Atheism and Rationalism’ বইয়ে নাস্তিকতার (Atheism) সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “when we examine the components of the word ‘atheism, we can see this distinction more clearly. The word is made up of ‘a-’ and ‘-theism.’ Theism, we will all agree, is a belief in a God or gods. The prefix a-’ can mean ‘noť (or ‘no’) or ‘without’. If it means ‘not,’ then we have as an atheist someone who is not a theist (i.e., someone who does not have a belief in a God or gods). If it means ‘without, then an atheist is someone without theism, or without a belief in God”. (p. 3. Prometheus, 1980)।
আমরা যদি ‘atheist’ শব্দটির আরও গভীরে যাই তবে দেখব যে, এটি আসলে উদ্ভূত হয়েছে গ্রিক শব্দ ‘a’ এবং ‘theos’ থেকে। গ্রিক ভাষায় ‘theos’ বলতে বোঝায় ঈশ্বরকে, আর ‘a’ বলতে বোঝায় অবিশ্বাস বা বিশ্বাসহীনতাকে। সেজন্যই Michael Martin তাঁর “Atheism: A Philosophical Justification” বইয়ে বলেন, “According to its Greek roots, then, atheism is a negative view, characterized by the absence of belief in God.”
সৃষ্টিকর্তা বা একেশ্বরে অবিশ্বাসীদের নাস্তিক বলা হয়নি। সৃষ্টিকর্তা বা একেশ্বরের ধারণাই তো সৃষ্টি হয়নি। সর্বপ্রথম নাস্তিক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল লোকায়তিকদের প্রতি। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের অনুসারীদের লোকায়তিক বলা হয়। নির্দিষ্ট করে বললে–যাঁরা বেদের ক্রিয়া-কাণ্ড, যাগ-যজ্ঞাদিকে অনর্থক বলেছেন বেদকে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে স্বীকার করেননি এবং পরলোকে অবিশ্বাসী, এমন ভাবসম্পন্ন ব্যক্তিকে নাস্তিক বলা হয়েছে। সেই কারণেই নাস্তিক চার্বাকদের বেদবিশ্বাসীরা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। বেদবিশ্বাসীদের মতে বৌদ্ধধর্মও নাস্তিক। কারণ বৌদ্ধরাও বেদবিরোধী। বেদবিশ্বাসীরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরও নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস নিয়েছিল। ভারত থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হলেও বৌদ্ধধর্ম ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। অবশেষে বেদবিশ্বাসীরা পরাজিত হয়ে বিষ্ণুর দশমাবতারে এক অবতারে বুদ্ধদেবকে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
সনাতন-ধর্মীয় মনুসংহিতা নাস্তিকের উপমায় বলছে –“সোহবমন্যেত তে মূলে হেতুশাস্ত্রাশয়াদ্বিজঃ। স সাধুভিহি, কাৰ্য্যো নাস্তিকো বেদনিন্দুকঃ”(২/১১)। অর্থাৎ “যে ব্যক্তি প্রতিকূল তর্ক দ্বারা মূলস্বরূপ শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্রকে অবমাননা করে, সাধু লোকেরা সেই বেদনিন্দক নাস্তিককে দ্বিজের কর্তব্য কর্ম অধ্যায়নাদি সকল অনুষ্ঠান হতে বহিস্কৃত করবেন।”
বিশিষ্ট বৈয়াকরণিক পাণিনির ব্যাখ্যা মতে যে ব্যক্তি পরলোকে কর্মফলে বিশ্বাস করে না, সেই নাস্তিক। অতএব প্রতীয়মান হয় যে, তৎকালে নিরীশ্বরবাদী নয়, বরং পরলোকে অবিশ্বাসী, বেদ অস্বীকারকারী এবং বেদ-নিন্দুককেই নাস্তিক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এই দর্শনই নাস্তিকতা। নিরীশ্বরবাদীদেরকেই পাশ্চাত্যে ইংরেজিতে বলা হচ্ছে Atheist এবং এর দর্শনকে বলা হয়েছে Atheism. Jullian Baggini তাঁর “Atheism : A very sort introduction to the meaning of a atheist’s commitment to naturalism” প্রবন্ধে লিখেছে–“What most atheists do believe is that although there is only one kind of stuff, in the universe and it is physical, out of this stuff come minds, beauty, emotions, moral valued–in short the full gamut of phenomena that gives richness to human life.”