ইতিহাস আমাদের সাক্ষী দেয় হাজার হাজার কাল ও শতাব্দীর সোপান অতিক্রম করে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে মানুষের ভয়, কৌতূহল এবং আপন অস্তিত্বকে জানার প্রয়োজনে–ঈশ্বরের প্রয়োজনে নয়। বৌদ্ধধর্ম ছাড়া পৃথিবীর সব ধর্মই তাঁদের অনুসারীদের নিঃশর্ত আনুগত্য এবং অন্ধবিশ্বাস দাবি করে। বৌদ্ধধর্ম তথাকথিত কোনো সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে না। স্বীকার করে না কোনো অবতার বা নবিতে। বুদ্ধ তাঁর অনুসারীদের বলেছেন, কারও কোনো কথা বিশ্বাস কোরো না, যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে তা গ্রহণ করো, এমনকি আমি বললেও বিশ্বাস কোরো না। সেই ২৫০০ বছর আগে একজন মানুষের পক্ষে একথা বলা যে কী মহাবিপ্লবের কাণ্ড তা আজকে ঠিক উপলব্ধি করা যাবে না।
কোনো সৃষ্টিকর্তা বা দেব-দেবতারা নিজে বা নিজেরা স্বয়ং এসে তাঁদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে কোনো ধর্মশিক্ষা দিয়ে যায়নি মানুষকে। মানুষই বরং তাঁদের চিন্তা-ভাবনা দ্বারা তাঁদেরকে কল্পনা করে ধর্ম ও ধর্মীয় কাহিনি আকার দিয়ে প্রচলন করেছে। ঈশ্বরবাদী ধর্মের আগমন ঘটে শাসক-মানুষের কল্পনাশক্তির বিকাশের পর। আদিযুগে মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে যত্রতত্র কিছু কিছু মানুষ সমীহ আদায় করে নেওয়ার জন্য নিজেকে ‘অবতার’ বলে জাহির করত। তিনি যে সত্যিই অবতার এবং তিনি ঈশ্বরপ্রেরিত তা জাহির করতে নানারকম ভেলকি-মায়াজাল-ইন্দ্রজাল-অলৌকিক কাণ্ডকারখানা করতেন। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষ ভেলকি-মায়াজাল-ইন্দ্রজাল-অলৌকিক কাণ্ডকারখানা দেখে যেভাবে বিস্ময়ে হা হয়ে থাকেন, হাজার হাজার আগে মানুষের হা তো আরও বিস্ময়াভূত ছিল, তাই না? লকলকে আগুন খাওয়াটা এখন অনেকেই জেনে গেছেন কীভাবে সম্ভব, কিন্তু প্রাচীনযুগে মানুষ জানতেন আগুন খাওয়াটা কোনো মানুষের কম্মো নয়–দেবতা বা দেবতাপ্রেরিত অবতারেরই কম্মো। এইভাবে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন দেবতা বা অবতারকে কেন্দ্র করে গোষ্ঠী বা লবি বা বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা তৈরি হত। এই গোষ্ঠী বা লবির ধারণা বা বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়তই সংঘটিত হত যুদ্ধ-বিগ্রহ-হত্যা-হানাহানি। প্রাচীন ভারতে কিছু চতুর মানুষ নিজেকে সৃষ্টিকর্তার অবতার বলে দাবি করত। ভারতীয় হিন্দু (সনাতনধর্ম) অবতারের আবির্ভাব এখনও চলছে। প্রতি বছর কেউ-না-কেউ নিজেকে অবতার বলে দাবি করে বসে। এদেরই কোনো কোনো অবতারেরা নানা কেচ্ছা-কেলেঙ্কারীতে হাবুডুবু খেয়ে শ্রীঘরে আশ্রয় পেয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি ৭৫ বর্ষীয় বৃদ্ধ আশারাম বলে একজন অবতার নারীঘটিত কেচ্ছায় জড়িয়ে এখন শ্রীঘরে। তাঁর ১০কোটি শিষ্য, এই ১০ কোটি শিষ্য কি এরপর আশারামের শিষ্যত্ব ত্যাগ করেছেন? করেননি। উলটে শিষ্যদের কেউ কেউ আশারামকে রক্ষা করতে নগ্নভাবে মাঠে নেমে পড়েছেন।
ধর্ম যুক্তিবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে চলে না। ধর্মবিশ্বাসীরা কোনো যুক্তি মানেন না, যুক্তি মানা পছন্দ করেন না–যুক্তির কথায় ভয়ংকর ক্ষেপে যান। ভাবুন তো, ধর্ম এবং ঈশ্বরের যদি সকল জীবের স্রষ্টা হন তাহলে এত মতান্তর কেন? এত ভিন্নতা কেন? ঈশ্বর বা ধর্ম যদি এতই সর্বশক্তিমান হন তবে এক পৃথিবীতে এক ধর্মের এক ঈশ্বর সৃষ্টি করতে পারলেন না কেন? ধর্মে-ধর্মে এত হানাহানি কেন? ঈশ্বরে-ঈশ্বরে এত ভেদ-ভাও-বিভেদ কেন? আচার-বিচারে এত বৈসাদৃশ্য কেন? সে প্রশ্ন করেননি কেন আস্তিকবন্ধুরা? প্রশ্ন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না আপনারা?
ইসলাম ধর্ম এক বাক্যেই সব ধর্মকেই নাকচ করে দেয়। কোরানে বলছে : “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম (৩ : ১৯)”। অর্থাৎ বাকি সব ধর্ম ঈশ্বরের অমনোনীত ধর্ম বা সেগুলি কোনো ধর্মই নয়। ইসলাম মতে, মুসলমানরা মৃত্যুর পর বা পাপমোচনের পরে চিরদিনের জন্য বেহেস্তে যাবে এবং অবিশ্বাসীরা চিরদিনের জন্য দোজখে যাবে (২ : ৩৯)। অর্থাৎ মুসলিম ছাড়া বাকি সব অন্য ধর্মে অনুসারীদের সকলেরই মৃত্যুর পর ঠিকানা হবে দোজখ বা নরকে। অপরদিকে হিন্দু তথা সনাতনধর্মীরা দাবি করেন তাঁদের ধর্ম চিরায়ত ধর্ম। সেই আদিমকাল থেকে তাঁদের ধর্ম চলে আসছে, তাই তাঁদের ধর্ম খাঁটি এবং সর্বোত্তম। যদিও অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীর এই ধর্মে স্বাভাবিক প্রবেশাধিকার নেই। তাই হিন্দুধর্মে উল্লেখ আছে, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্ম ভয়াবহোঃ”–অর্থাৎ, নিজের ধর্মে বিশ্বাসী থেকে মৃত্যুবরণ করলে পুরস্কার প্রাপ্তি, ভিন্ন ধর্মগ্রহণ করলে ভয়ংকর শাস্তি। বিধর্মীদের আছে রৌরব নামে নির্দিষ্ট নরক। অতএব অহিন্দু মাত্রই যবন, ম্লেচ্ছ ইত্যাদি। তা সত্ত্বেও সবচেয়ে বেশি ধর্মান্তরিত হয়েছে এই হিন্দুধর্ম থেকেই। হিন্দুধর্মের একটা বড়ো অংশই স্বধর্ম ত্যাগ করে হয় ইসলামধর্ম, হয় খ্রিস্টানধর্ম, নয়তো বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। ইহুদিরা প্রচণ্ড ধর্মীয় জাতীয়বাদে বিশ্বাসী। তাঁরা নিজেদের ঈশ্বরের একমাত্র মনোনীত জাতি বলে মনে করেন, বাকি সবাই এ পৃথিবীতে অবাঞ্ছিত। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে, সকল মানুষ আদি পাপের বোঝা নিয়ে এই ধরাধামে জন্মান। সকল মানুষই অনন্তকালের নরকভোগের উপযুক্ত, শুধু খাঁটি খ্রিস্টানরাই ব্যতিক্রম থাকবেন। আবার বৌদ্ধধর্মের মূলধারাটি নিরীশ্বরবাদী হওয়ায় অনেকে একে ধৰ্মই মনে করেন না–বৌদ্ধগণ মনে করেন, এটি একটি দর্শন।