অষ্টাদশ শতকের জ্ঞানবাদী আন্দোলনের এক তাত্ত্বিক নেতা ব্যারন ডি হোলবাচ The 126679, “We find in all the religions of the earth, ‘a God of armies’, ‘a jealous God’, ‘an avenging God’, ‘a destroying God’, ‘a God who is pleased with Carnage’… .” পণ্ডিত ডেনিস দিদেররা পোপ তৃতীয় ক্লেমেন্ট রাষ্ট্রের প্রবল বাধা অতিক্রম করে ষোলো খণ্ডে পৃথিবীর প্রথম বিশ্বকোষ বা এনসাইক্লোপিডিয়ার সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। দিদেরো মনে করতেন, “ধর্মের প্রতি যে-কোনো ধরনের সহানুভূতি প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের সঙ্গে আপোষেরই নামান্তর।” জার্মান দার্শনিক ফ্রাহিদ্রিশ ভিলহেম নিটশে বলেন—”যাঁরই ধমনীতে ধর্মতাত্ত্বিকের রক্ত আছে তিনি একেবারে প্রথম থেকেই সবকিছুর প্রতি ভ্রান্ত ও অসৎ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন।… ধর্মতাত্ত্বিক যাকে সত্য বলে মনে করেন তা অবশ্যই মিথ্যা; এটিই সত্যতা নির্ণয়ের একটি মাপকাঠি।”
এলবার্ট হিউবা বলেন–”ধর্মতত্ত্ব হল কিছু লোকের একটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা, যে বিষয়টি তাঁরা বোঝেন না। সত্য কথা বলা ধর্মতাত্ত্বিকদের উদ্দেশ্য নয়, ধর্মানুসারীদের খুশি করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।” ভারতীয় বস্তুবাদী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে বলেন–“অজ্ঞানতার অপর নাম ঈশ্বর। আমরা আমাদের অজ্ঞানতাকে স্বীকার করতে লজ্জা পাই এবং তার জন্য বেশ ভারী গোছের একটা নামের আড়ালে আত্মগোপন করি। সেই ভারী গোছের আড়ালটির নামই ঈশ্বর। ঈশ্বর বিশ্বাসের আরও একটি কারণ হল বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের অপারগতা ও অসহায়ত্ব। .অজ্ঞানতা আর অসহায়ত্ব ছাড়া আর কোনো কারণ যদি ঈশ্বর বিশ্বাসের পিছনে থেকে থাকে তা হল ধনী ও ধূর্ত লোকদের নিজ স্বার্থ রক্ষার প্রয়াস। সমাজে চলতে থাকা সহস্র অন্যায় অবিচারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য তাঁরা ঈশ্বরের অজুহাতকে সামনে এনে রেখেছে। …ঈশ্বর বিশ্বাস এবং একটি সহজ সরল ছোটো শিশুর নিজস্ব বিশ্বাস, বস্তুত একই। পার্থক্য শুধু এইটুকুই ছোটো শিশুটির যুক্তি ভাঙার, উদাহরণ ইত্যাদির পরিমাণ খুবই সামান্য, আর বড়দের ওগুলো খানিকটা বিকশিত।” আলবেয়ার কাম তাঁর ‘The Rebel’ গ্রন্থে বলেন–”One must learn to live and to die and in order to be a man, to refuse to be a God.” অর্থাৎ একজনকে বাঁচা এবং মরার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং মানুষের মতো বাঁচতে হলে ঈশ্বরকে অস্বীকার করতেই হবে।
ধর্মীয় অন্ধগোষ্ঠীর হাতে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি দগ্ধ হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে এই লাইব্রেরি ছিল পৃথিবীর জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রস্থল। আর ধর্মীয় অন্ধগোষ্ঠীর হাতে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিই পোড়ানো হয়নি, পোড়ানো হয়েছে। হাজার বছরের জ্ঞানভাণ্ডার। এক কল্পিত ঈশ্বরের স্বেচ্ছাচারিতায় ভূলুণ্ঠিত হয়েছে মানবসভ্যতার তিল তিল গড়ে তোলা অর্জিত জ্ঞান। কিন্তু মানুষ কখনো অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিজেকে ডুবিয়ে রাখেনি। মানবসভ্যতার উন্নয়নের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মানুষ এই অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম নামক অন্ধকার শক্তি প্রতিনিয়ত মানুষকে পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। কল্পিত ঈশ্বর এবং চ্যালা-চামুণ্ডারা সবসময় চেষ্টা করছে মানবসভ্যতার ধ্বংসসাধনের জন্য।
আমি যদি নাস্তিক হয়ে থাকি সেই নাস্তিক্যবাদ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার প্রতি ধর্মীয় প্রতিন্যাসের চেহারা দেখে। শিশুকাল থেকে পথেঘাটে দেখে আসছি ভিখারি, অর্ধাহারী অনাহারী মানুষ, কুষ্ঠরোগী, চড়া রং চড়ানো বেশ্যা। অনেককেই বলতে শুনেছি এসব নাকি পূর্বজন্মের পাপকর্মের ফল! কে, কার, কখন পূর্বজন্ম প্রত্যক্ষ করেছেন –এ পৃথিবীতে তেমন একজন মানুষ আজ অবধি জন্মেছেন? ইতিহাসে এসব সিদ্ধান্তের কোনো নথি নেই। মহামারি ও দুর্ভিক্ষের ঘটনা যখন জেনেছি, দেশে-দেশে যুদ্ধ ও ধর্মে-ধর্মে খুনোখুনি যখন দেখেছি, যখন পড়েছি নিগ্রোদের উপর শ্বেতকায় মার্কিনীদের অত্যাচারের ইতিহাস, যখন জার্মানিতে ইতিহাস হয়েছে ইহুদি নিধনের মর্মন্তুদ কাহিনি–তখন এই ঘটনাগুলোর সাফাই দিতে আস্তিক্যবাদীরা আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন এসব কিছুই পরমকরুণাময়ের ইচ্ছা, তিনি যা কিছু করেন সবই মঙ্গলের জন্য –তাহলে বলব সব অত্যাচার, অবক্ষয়, যন্ত্রণার পিছনে সেই পরমকরুণাময়ই সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে আছেন? তা আমার পক্ষে মানা সম্ভব নয়। যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট জাপানের লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ শিশুদের হত্যা করে নির্মমভাবে, তখন সেই পরমকরুণাময় কোথায় থাকেন? যখন ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেইন হাজারে হাজারে কুর্দৰ্জাতিদের কুকুর-বেড়ালের মতো হত্যা করে, তখন কোথায় থাকেন সর্বশক্তিমান সেই ঈশ্বর?
লেখক জর্জ ওয়াটসন তাঁর “Sons of the Morning” গ্রন্থে বলেছেন–“ধর্মবিশ্বাসের ফলে মানুষের আত্মশক্তির প্রকাশ ও বিকাশের পথে দুস্তর বাধার সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু অন্ধকার মুছে ফেলে সেই আলোর দিন আসছে নতুন কালের বার্তা নিয়ে যার মূল সুর হবে মানুষই ধর্ম, মানুষের ধর্ম ছাড়া আর কোনো ধর্ম নেই। এবং এই মানুষের ধর্ম হবে জিজ্ঞাসা ও অবিরাম বিজ্ঞানচেতনা”। এ পর্যন্ত ধর্ম অসহায় মানুষদের ধর্মান্ধ তা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। এই কারণেই প্রয়োজন ধর্মান্ধ এই দেশে তথা সারাবিশ্বে ধর্মাশ্রয়ী সংস্কৃতির বিপরীতে নাস্তিকতার সংস্কৃতি। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ১০০ কোটির বেশি মানুষ নাস্তিক অথবা ধর্মহীন। তাঁরা সকলেই বুদ্ধিহীন নয়, তাঁরা অবশ্যই বুদ্ধিমান–জ্ঞানী। মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের ভালোর জন্য কাজ করা, সততা-মূল্যবোধ ইত্যাদির মতো মানবিক চেতনাকে তাঁরা স্বাভাবিক নিয়মেই অনুসরণ করেন, কোনো ঈশ্বর, অবতার, গুরু অথবা কোনো অলৌকিক অতিপ্রাকৃত শক্তির ভয়ে নয়। ভয় যে থাকে না তা কিন্তু নয়, ভয় মনুষ্যত্ব হারানোর ভয়। এই ভয়টাই নিরীশ্বরবাদী অথবা তথাকথিত ধর্মহীন মানুষদের সাহস জোগায়। আত্মবিশ্বাসই নিরীশ্বরবাদী অথবা তথাকথিত ধর্মহীন মানুষদের একমাত্র শক্তি।