নাস্তিক্যবাদ নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে তখন কমিউনিস্টদের ধর্মচিন্তার বিষয়ে সামান্য আলোচনা হবে না? আচ্ছা, কমিউনিস্টরা কি ধর্মবিরোধী? নাস্তিক? কার্ল মার্কসের যে বিখ্যাত বাণী গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীরা ব্যবহার করে, তা হল –“Religion is the opium of the masses” অর্থাৎ “ধর্ম হল জনগণের জন্য আফিম”। অতএব কমিউনিস্টরা নাস্তিক,ধর্মে বিশ্বাস করে না। মার্কসের তত্ত্ব হল–“ধর্ম হল নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, ঠিক যেমন সেটা হল আত্মবিহীন পরিবেশের আত্মা। ধর্ম হল জনগণের জন্য আফিম। মানুষের মায়াময় সুখ হিসাবে ধর্মকে লোপ করাটা হল মানুষের প্রকৃত সুখের দাবি করা। বিদ্যমান হালচাল সম্বন্ধে মোহ পরিত্যাগের দাবিটা হল যে–হালচালে মোহ আবশ্যক, সেটাকে পরিত্যাগের দাবি। তাই ধর্মের সমালোচনা হল ধর্ম যার জ্যোতিমণ্ডল সেই অশ্রু উপত্যকার সমালোচনার সূত্রপাত”।
মার্ক্স বলেছিলেন ধর্ম জনগণের জন্য আফিম। আর আমাদের মার্ক্সবাদীরা বলেন, “না না, মার্ক্স সরাসরি এমন কথা ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলেননি। তিনি তো শুধু বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, এই পুঁজিবাদীরা ধর্মকে আফিমের মতো করে ব্যবহার করে; তাঁদের পুঁজিবাদী স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে”। আর সেইজন্যই বোধহয় কমিউনিস্টদের পুজো কমিটি বা বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে সেক্রেটারি/সভাপতি/উদ্যোক্তা হিসাবে দেখা পাওয়া যায়। অথবা পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন কমিউনিস্ট পরিবহনমন্ত্রী সুভাষচক্রবর্তীকে তারাপীঠের মন্দিরে বারবার পুজো দিতে দেখা যায়, কমরেড নাম্বুদ্রিপাদকে (ইল্লিকুল্লা মনাক্কেল শংকরণনাম্বুদ্রিপাদ) তাঁর পরিবারকে নিয়ে তিরুপতি মন্দিরে পুজো দিতে দেখা যায়। অতএব কমিউনিস্ট মানেই নাস্তিক্যবাদী নয়। কমিউনিস্ট হলেই নাস্তিক্যবাদী হওয়া যায় না। অপরদিকে নাস্তিক্যবাদী মানেই তিনি কমিউনিস্ট নয়। সাহিত্যিক ফিলিপ অ্যাডামসের মতে, “মার্ক্স ভুল ছিলেন। ধর্ম মানুষের মাদকাসক্তি নয়। মাদক মানুষকে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, অসাড়তা আর বোধহীনতা দেয়। কিন্তু প্রায়শই ধর্ম এমন এক ভীতিকর উদ্দীপকের নাম, যা জাগ্রত করে মানুষের পশুত্বকে। শুধু মার্কসবাদীরাই ধর্মের বিরুদ্ধে লড়েনি। ধর্মের বিরুদ্ধে আলোচনা-সমালোচনা করলেই বলা হয় ‘কমিউনিস্ট’ বা ‘মাকু’ বা ‘সেকু’। যেন নাস্তিক মানেই কমিউনিস্ট। ধর্মের সঙ্গে সংগ্রামটা হল বুর্জোয়া বিপ্লবের অবশ্য কর্তব্য। ফ্রান্স এবং জার্মানির উভয় দেশেরই আছে ধর্মের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া সংগ্রামের ঐতিহ্য। সেকুলারিজম, নাস্তিক্যবাদ ইত্যাদি ধারণা ও প্রত্যয়ের জন্য কমিউনিস্টরা আসলে চিরায়ত বুর্জোয়ার উদ্ভাবিত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের কাছে বিপুলভাবে ঋণী। বুজোয়া সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের ঘোর বিরোধ থাকা সত্ত্বেও মানবসভ্যতার বিকাশে বুর্জোয়াদের যা কিছু ইতিবাচক অবদান কমিউনিস্টরা তা শুধু অকুণ্ঠ স্বীকৃতিই দেয় না, আত্মস্থ করার ভিতর দিয়ে সেগুলোকে আরও বিকশিত করার কর্তব্য বোধ করে।
আধুনিক সচেতন শ্রমিক ঘৃণাভরে ধর্মীয় কুসংস্কারকে প্রত্যাখান করেছে। মৌলবি-পুরোহিত ও বুর্জোয়া ভণ্ডদের জন্য স্বর্গ ছেড়ে দিয়ে তাঁরা নিজেরা এই পৃথিবীতে উন্নততর জীবন জয়ে উদ্যোগী। ধর্মের কুহেলিকার বিরুদ্ধে সংগ্রামে শ্রমিকরা বিজ্ঞানকে টেনে আনছে এবং পৃথিবীতে উন্নত জীবনের জন্য সত্যিকার সংগ্রামে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের প্রত্যয় থেকে তাঁদের মুক্ত করছে। পরলোকে স্বর্গ সৃষ্টি সম্বন্ধে শোষিত শ্রেণির মতৈক্য অপেক্ষা পৃথিবীতে স্বর্গ সৃষ্টির জন্য নির্যাতিত শ্রেণির এই সত্যিকার বৈপ্লবিক সংগ্রামের ঐক্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ কমিউনিস্ট মানেই নাস্তিক্যবাদী নন, নাস্তিক্যবাদী মানেই কমিউনিস্ট নয়। মার্কসবাদ-লেলিনবাদ পাঠ এবং জীবনে প্রয়োগপূর্বক যে-কারোর পক্ষেই কমিউনিস্ট হওয়া সম্ভব, নাস্তিক্যবাদী হওয়া কোনোমতেই সম্ভব হয়। বামপন্থী অথবা ডানপন্থী –যে-কেউ নাস্তিক্যবাদী হতে পারেন, যদি তিনি যুক্তিভিত্তিক জ্ঞানলাভ করতে পারেন। নাস্তিক তিনিই, যিনি পার্থিব কোনো ভালো বা মন্দ কাজের দায় অদৃশ্য কারোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেন না।
ধর্ম আর ধর্মবিশ্বাসীদের ব্যাপারে ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের বলেন, “পৃথিবীর প্রথম পুরোহিত বা মোল্লা ব্যক্তিটি হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম ধূর্ত বাটপাড়, যাঁর মোলাকাত হয়েছিল প্রথম বোকা-নির্বোধ ব্যক্তিটির সঙ্গে–বাটপাড় ব্যক্তিটি নির্বোধ ব্যক্তিকে বুঝিয়ে-পড়িয়ে নিজের অনুগত প্রথম ভক্ত বানিয়ে ফেলে। ক্রমে পুরোহিত তথা ধর্মযাজকেরা নতুন নতুন সুযোগ বুঝল –সৃষ্টি হল পুরোহিততন্ত্র বা মোগ্লাতন্ত্র–তাঁরা সহজ-সরল মানুষের অন্ধবিশ্বাসের সুযোগে সাধারণ মানুষ অপেক্ষা উৎকৃষ্টতা ও ডিভাইনিটি দাবি করল। মানুষ তাঁদের দাবি মেনে নিল, সঙ্গে সঙ্গে ধর্মযাজকেরা উৎপাদনশ্রম থেকে রেহাই পেল। পুরুষ মৌমাছি মধুমক্ষিকার মতো তাঁরা সাধারণের কষ্টার্জিত সম্পদ শুয়ে-বসে ভোগ করতে লাগল। মানুষের ধর্ম-বিশ্বাস, দুর্বলতা, বিশ্বাসপ্রবণতা, সরলতা ইত্যাদিকে হাতিয়ার করে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে যুগে যুগে অনাচার, রক্তপাত, ডাইনি শিকার, শোষণ, নিপীড়ন প্রভৃতির মহড়া চালিয়ে আসছে তথাকথিত ডিভাইনিটির দাবিদার ডিভাইন পুরোহিতেরা।”