মানুষের নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস থাকতে পারে। কোনো কিছু পরে যদি কারোর বিদ্বেষ থাকে, সেটি দোষের কিছু নয়। মানুষের যেমন অমানুষের প্রতি বিদ্বেষ থাকে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের যেমন জামায়াত-শিবির, রাজাকারের প্রতি বিদ্বেষ থাকে, অনেক মুসলমানের যেমন হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ থাকে, অনেকের যেমন নেতা-নেত্রী-কর্মীদের উপর বিদ্বেষ । থাকে। কারণ সবার যে সবকিছু ভালো লাগবে, পছন্দ হবে; এমন কোনো কথা নেই। বিদ্বেষের জন্য কারোর শাস্তি চাওয়া মূর্খের কাজ, ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। সর্বশেষ আসি, ধর্মবিরোধী বিষয়ে। আস্তিকেরা-ধার্মিকেরাও মনে করে থাকে, নাস্তিক মানেই ধর্মবিরোধী। ধর্মবিরোধীদের শাস্তি চায় অনেকে। যেন ধর্মবিরোধী হওয়া তাদের কাছে অন্যায়। নাস্তিকেরা ধর্ম মানে না, তাই তারা ধর্মবিরোধী হতে পারে। কোনো কিছুর বিরোধী হওয়া অন্যায় নয়। যুক্তিযুক্ত হলে তো কোনো অন্যায়ের প্রশ্ন আসে না। অনেক আস্তিক-ধার্মিক-নাস্তিকেরা প্রায়ই বলে থাকে, নাস্তিক হলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ঈশ্বর-ধর্মের সমালোচনা-নিন্দা-ব্যঙ্গ করা দোষের। এই বিষয়েও একটু বিশ্লেষণ করা যাক। নাস্তিকেরা যেহেতু কুপ্রথা, ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্মীয় প্রথাবিরোধী, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী; সেহেতু তারা যদি ঈশ্বর-ধর্মের ভুল বের করে, সমালোচনা করে; তবে এটি দোষের কিছু নেই। বরঞ্চ এটি সকলের ব্যক্তি-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এটিতে হস্তক্ষেপ করাও অবশ্যই অপরাধ। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে ব্যঙ্গ যেমন করা যায়, তেমন ঈশ্বর-ধর্ম বিষয়েও ব্যঙ্গ করা যায়। ব্যঙ্গ করা কোনো অন্যায় না, কোনো অপরাধ না। ঠিক তেমনভাবে ঈশ্বর-ধর্মের নিন্দা করাও কোনো অপরাধ না। অনেক আস্তিক-ধার্মিক-নাস্তিকেরা বলে থাকে, ঈশ্বর-ধর্মের ভুল ধরার আগে, সমালোচনা করার আগে নাস্তিকদের উচিত নিজের পরিবারকে নাস্তিক বানানো। এটিও হাস্যকর কথা। নাস্তিকদের লক্ষ্য কাউকে নাস্তিক বানানো নয়। কুপ্রথার বিরুদ্ধে কথা বলা, ধর্মান্ধ-মৌলবাদ, বিজ্ঞান প্রচার করাই নাস্তিকদের লক্ষ্য।
বাংলাদেশের অনেক নাস্তিককেও দেখা যায়, মূর্খের মতো অযৌক্তিক কথা সমর্থন করতে। আবার অনেক নাস্তিকেরা কোনো যুক্তি না-দিয়ে, নিজের মন গড়া কথা বলে ঈশ্বর-ধর্ম নিয়ে। তাঁরা ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বাসী হলেও তারা প্রকৃত নাস্তিক নয়, তাদের চিন্তা-চেতনা, মানসিকতা নীচু মানের। তারা যে কোনো দাঙ্গা বাঁধতে পারে। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমানেরা ধর্মান্ধ। তাই তাঁরা যে-কোনো কিছুর ভুল বুঝে, দাঙ্গা তৈরি করতে পারে। এই ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমানেরা বাংলাদেশের অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম স্বাভাবিকভাবে দেখে না। বরঞ্চ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে অহেতুক ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, তাঁদের ধর্ম-দেব-দেবী নিয়ে ঠাট্টা করে। বাংলাদেশের মুসলমানেরা ভাবে তাঁদেরই একমাত্র আদর্শ-অনুভূতি আছে। অন্যদের কোনো আদর্শ-অনুভূতি নেই। বেধর্মীদেরসহ নাস্তিকদের হত্যা করার চেষ্টা করে। হত্যা করে কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। যার-যার বিশ্বাস অবিশ্বাসকে গুরুত্ব দেওয়া নৈতিক দায়িত্ব। এই পৃথিবী সকলের। এখন না জেনে-বুঝে কথা বলা বেশিরভাগেরই অভ্যাস হয়ে গেছে। এই অভ্যাস যেভাবেই হোক পরিত্যাগ করতে হবে। এটিও সবাইকে মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সবাই মানুষ না; পৃথিবীতে মানুষ, অমানুষ উভয়ই আছে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানুষ পরিচয়। মানুষের মানুষ পরিচয়কে সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ভাবলেই পৃথিবী সুন্দর হবে। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই!”
‘A Brief History of Time’-এর লেখক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং আবারও বলেছেন, ঈশ্বর বলে কিছু নেই। নিজেকে নাস্তিক’ বলেও উল্লেখ করেছেন। হকিং বলেছেন, “যখন আমরা সেভাবে বিজ্ঞান বুঝতাম না, তখন এটা বিশ্বাস করাই স্বাভাবিক ছিল যে, পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর। কিন্তু (মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্যের বিষয়ে) বিজ্ঞান এখন জোরদার ব্যাখা দিতে সক্ষম।” হকিং বলেন, “ঈশ্বর থাকলে আমরা তার মনকে পড়ার চেষ্টা করতাম। তার মনকে পড়তে পারা মানে সবকিছু জেনে যাওয়া। আসলে কিন্তু ঈশ্বর বলে কিছু নেই। আর আমি একজন নাস্তিক।” স্প্যানিশ দৈনিক ‘এল মানো’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন তাত্ত্বিক এই পদার্থবিজ্ঞানী। স্টারমাস ফেস্টিভালে অংশ নিতে হকিং স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে অবস্থান করেছেন। প্রসঙ্গত, ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘A Brief History of Time’। সেখানে “ঈশ্বরের মন’ নিয়ে কথা বলেন হকিং। ওই বইতে তিনি লেখেন, “ঈশ্বরের মনকে জানা উচিত’ বিজ্ঞানীদের। ঈশ্বর নেই’- এমন কথা কিন্তু হকিং আগেও বলেছেন, কয়েকবার। ২০১১ সালে ‘The Guardian’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হকিং বলেছিলেন, “ঈশ্বর এক বানোয়াট গল্প। স্বর্গ বা পরলোকে আমি বিশ্বাস করি না।” এরও আগে ২০০৭ সালে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হকিং বলেছিলেন, “বিজ্ঞানের নিয়মনীতিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে আমি বিশ্বাস করি। হতে পারে ঈশ্বরই এ সব নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু নিয়মগুলো ভাঙার জন্য ঈশ্বর কখনও ঝামেলা পাকান না।”