অতএব আস্তিক্যবাদীরা মনে করেন–যাঁর যাঁর স্থানে অবস্থান করে শাস্ত্রীয় মতানুসারী, পারম্পরিক, জ্যোতিষী, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা যাঁর যাঁর স্রষ্টাকে অবশ্যই বিশ্বাস করেন তাঁরা সবাই আস্তিক। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় যেহেতু সবাই যাঁর যাঁর স্রষ্টাকে বিশ্বাস ও মান্য করেন সেহেতু পৃথিবীতে ‘নাস্তিক’ বলে কেউ নেই। ফলে পৃথিবীতে নাস্তিক ও নাস্তিক্যবাদ বলে কিছুই নেই। আরও বলা যায়–মানুষ স্থূল দৃষ্টিতে একে অন্যকে নাস্তিক বলে অবুঝের মতো গালাগালি করলেও সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে সারা বিশ্বের কোথাও নাস্তিক বা নাস্তিক্যবাদের অস্তিত্ব বলে কিছুই নেই। কার্যত যাঁর যাঁর মনের মতো করে তাঁর তাঁর স্রষ্টার হাত, পা, চোখ, মুখ, কান, নাক, মন, জ্ঞান, রাগ, বিবেক ও বিচার সৃষ্টি করে তা অন্যকে বিনা বিচারে গ্রহণ করতে বা মেনে নিতে বলবেন তখন কেউ মেনে না নিলেই তাঁকে নাস্তিক বলবেন, এটা কখনই হতে পারে না। একটু ভালোভাবে লক্ষ করলেও দেখা যায় কারও স্রষ্টার হাত, পা, মুখ, বিবেক ও বিচার ইত্যাদি আছে, আবার কারও স্রষ্টার এসব নেই। তাহলে স্রষ্টা নির্মাণ একান্ত শৈল্পিক বিষয়। যাঁর যাঁর দলের রূপকার গুরু ও গোঁসাইরা ডাকার জন্য স্ব স্ব স্রষ্টা নির্মাণ করে তাঁকে মনের মাধুরিতে রূপদান করেছেন। সেটা হোক শাস্ত্রীয় স্রষ্টা বা বিজ্ঞানীদের স্রষ্টা। আস্তিক্যবাদীরা নাস্তিক্যবাদীদের নিয়ে আরও যা ভাবেন, তা হল–এটি রূপক সাহিত্যের বৈক্তিক সদস্য সারণির ‘অবিশ্বাসী পরিবারের অধীন একটি ‘রূপক পরিভাষা’ বিশেষ। তথাকথিত শাস্ত্রাদি-নির্ভর ও অন্ধবিশ্বাস-প্রসূত শাস্ত্রীয় নিরাকার উপাস্য কিংবা প্রতীতি মতবাদে অবিশ্বাসী এবং বস্তুবাদে বিশ্বাসীদেরকে অবিশ্বাসী বা নাস্তিক বলা হয়। সন্দেহ থেকেই অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। অবিশ্বাসকারীকেই নাস্তিক বলা হয়। কাউকে অধিক বিশ্বাস করাও ভালো নয়, আবার কাউকে অধিক অবিশ্বাস করাও উচিত নয়। যাচাই-বাছাই বা প্রমাণ সাপেক্ষে সব কিছুই বিশ্বাস করা উত্তম।
তবে যে-কোনো বিচারকমণ্ডলীর দ্বারা কোনো বিষয় প্রমাণিত হলে তা বিশ্বাস করায় কোনো অসুবিধা নেই। যদিও বিশ্বাস ও বাস্তবতার মধ্যে অমিল পাওয়া যায়। কোনো ব্যক্তির মনে অবিশ্বাসের পরিমাণ অধিক হলে তাঁকে মাঝে মাঝে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অবিশ্বাস থেকেই ঘরের তালা-চাবির আবিষ্কার হয়েছে বলে অনেকেই ধারণা করে থাকেন। আমাদের সমাজে সবসময় প্রায় পাঁচ প্রকার গল্পকাহিনি শুনতে পাওয়া যায়। যেমন –(১) দার্শনিক কাহিনি (২) বৈজ্ঞানিক কাহিনি (৩) রাজনৈতিক কাহিনি (৪) শাস্ত্রীয় কাহিনি ও (৫) পারম্পরিক কাহিনি। এদের মধ্যে কেবল শাস্ত্রীয় ও পারম্পরিক কাহিনির ক্ষেত্রে আমাদের আলোচ্য অবিশ্বাসী বা নাস্তিক পরিভাষাটি প্রযোজ্য। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসী বা নাস্তিক পরিভাষাটি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা দেখতে পাওয়া যায় না। শাস্ত্রীয় বিধিমালা অনুসারে শাস্ত্রীয় বিষয়বস্তু অস্বীকারকারীরা বিপথগামী এবং এটা অবিশ্বাসের ফলে অবশ্য-অবশ্যই তাঁরা নরকবাসী হবে।
নাস্তিক্যবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন মনে করেন–“চোর, গুণ্ডা, বদমাশ, ধর্ষক, খুনি, সন্ত্রাসীও নাস্তিক হতে পারে, হয়। তোমাদের আর তাঁদের মধ্যে তবে পার্থক্যটা কী! নাস্তিক হওয়াটা খুব কঠিন কিছু নয়, মাথায় ঘিলু থাকলেই নাস্তিক হওয়া যায়। কিন্তু নাস্তিক হয়ে তুমি সমাজের কী উপকারটা করবে শুনি? তুমি যদি ভালো মানুষ না হও, সততা যদি তোমার আদর্শ না হয়, তুমি যদি নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস না করো, সমকামীদের এবং লিঙ্গান্তরিতদের অধিকারে বিশ্বাস না করো, মানুষের দারিদ্র, দুর্ভোগ ঘোচাতে না চাও, বর্ণবাদ, আধিপত্যবাদ, শ্রেণিবাদ, জাতপাতের প্রতিবাদ না করো, অসাম্য, বৈষম্য, অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াও, তুমি যদি মুক্তচিন্তার পক্ষে, বিজ্ঞানমনস্কতার পক্ষে, সবার জন্য শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের পক্ষে কথা না বলো, তুমি যদি আমরা যাঁদের সঙ্গে এই পৃথিবীটা শেয়ার করছি সেই প্রাণীদের প্রতি সহানুভূতিশীল না হও, তবে চোর বদমাশ খুনি সন্ত্রাসীর নাস্তিকতার সঙ্গে তোমার নাস্তিকতার মূলত কোনো পার্থক্য নেই।”
অপরদিকে বাংলাদেশের আর-এক যুক্তিবাদী ও নাস্তিক্যবাদী জুয়েল ইয়াসির বলছেন –“বাংলাদেশের নাস্তিকেরা নামে নাস্তিক। অনেক নাস্তিককে দেখা যায়, শুক্রবারে জুম্মার নামাজ পড়তে, রোজা রাখতে, ইদের নামাজ পড়তে; অন্য ধর্মগুলো বিষয়ে এরকমও হতে পারে। এই বিষয়ে বিশ্লেষণ করা যাক। বাংলাদেশের আস্তিক-ধার্মিকেরা অধিকাংশই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। বাংলাদেশের আস্তিক-ধার্মিকেরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ, ধর্মপ্রবণ। তাই মুসলমান পরিবারগুলো ধর্মের প্রতি দুর্বল, অন্ধ। যখন মুসলমান পরিবারগুলোতে সন্তান জন্মানোর সাথে-সাথে আজান দিয়ে, পুরুষদের লিঙ্গের চামড়া কর্তন করে সন্তানের অজান্তে-অনিচ্ছায় ধর্মের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া সন্তানদের মুখে মা-বাবা ডাক শেখানোর পাশাপাশি, ঈশ্বরের ডাকটিও শেখানো হয়। যখন সন্তানদের ৫-৬ বছর বয়স হয়, তখন থেকে তাদেরকে ধর্ম মানানোর জন্য চাপ দেওয়া হয়, ধর্ম না মানলে, তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়। ওই সন্তানেরা যতদিন পর্যন্ত কর্মজগতে না-ঢুকতে পারে, ততদিন পর্যন্ত পরিবার থেকে ধর্ম গিলানোর জন্য চাপ দেওয়া হয়। তাই দেখা যায়, যারা ধর্মীয় বেড়াজাল ভেঙে নাস্তিক হয়, তারা যতদিন পর্যন্ত কর্মজীবনে প্রবেশ না-করে, ততদিন পর্যন্ত অনেককে পরিবারের চাপে নিয়মিতভাবে অনিয়মিতভাবে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ধর্ম গিলতে হয়। এতে তাদের আদর্শের কোনো ক্ষতি হয় না। বরঞ্চ ঈশ্বরের-ধর্মের দুর্বলতা বাস্তবে প্রমাণ হয়। তাই জোর করে ধর্ম গিলানোর মধ্যে কোনো সার্থকতা-সাফল্যতা নেই। পরে আসি উগ্র নাস্তিক বিষয়ে। আস্তিক-ধার্মিকেরা বলে থাকে, উগ্র নাস্তিক আর নাস্তিক এক না। কিন্তু উগ্র নাস্তিক বলে কিছুই নেই। কারণ উগ্র আস্তিকদের মতো উগ্র নাস্তিকেরা চাপাতি নিয়ে কাউকে হত্যা করতে যায় না, বোমা মারে না, খারাপ কাজ করে না। এগুলো করে আস্তিকেরাই। অনেক নাস্তিকদেরকেও দেখা যায়, আস্তিক-ধার্মিকদের সঙ্গে সমর্থন দিতে, একমত হতে। এরপরে আসি ধর্মবিদ্বেষী বিষয়ে। আস্তিক-ধার্মিকেরা, অনেক নাস্তিকেরাও মনে করে, ধর্মবিদ্বেষ অপরাধ অন্যায়। যারা ধর্মবিদ্বেষী, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। এটি একটু বিশ্লেষণ করা যাক।