(৫) গ্যালিলিও গ্যালিলাই যখন বললেন–সূর্য না, পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। এই কথা শুনে তৎকালীন খ্রিস্টান পাদরিরা তাঁকে ‘নাস্তিক’ উপাধি দিলেন।
(৬) কাজী নজরুল ইসলাম যখন হিন্দুদের দেবদেবীদের নিয়ে গান-কবিতা লিখেছিলেন, তখনও তাঁকে নাস্তিক বলা হল। কিন্তু বাংলা ভাষায় সব থেকে বেশি ইসলামিক গজল তারই রচনা।
(৭) বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন বোরখা পড়ায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই তাঁকেও নাস্তিক বলা হত।
(৮) লালন সর্ব ধর্মের উপাসক ছিলেন বলে তাঁকেও নাস্তিক বলা হত। বাংলাদেশী মৌলবাদী মুসলিমরা তাঁকে ‘নাস্তিকদের গুরু’ বলে থাকে।
মাহিরাহি নামে একজন লেখক একটা লেখায় শুনিয়েছেন। লেখাটির শিরোনাম হল –“পৃথিবীর প্রথম নাস্তিক দেশটি কেমন ছিল?” মনোরঞ্জনের জন্য লেখাটি এখানে উল্লেখ করলাম : “ছোটোকালে শুনতাম ইউরোপের একমাত্র মুসলিম দেশ হল গিয়ে আলবেনিয়া। অথচ এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম এবং একমাত্র নাস্তিক দেশ। পৃথিবীর প্রথম নাস্তিক দেশটির আয়ুষ্কাল ছিল ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে আনোয়ার হোজ্জা, আলবেনিয়াকে পৃথিবীর প্রথম নাস্তিক দেশ (এথেইস্ট স্টেট) সরকারিভাবে হিসাবে ঘোষণা দেন। সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পদ দখল করে নেওয়া থেকে ধর্মীয় নেতাদের বিদেশি শক্তিগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিভিন্নভাবে তাঁদেরকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। কাউকে পাঠানো হয় জেলে, কাউকে বাধ্য করা হয় কলকারখানায় কাজ করতে। এসব কিছুর পরও ধর্মীয় গোষ্ঠীকে দমনে ব্যর্থ হয়ে হোজ্জার পার্টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাস্তিকীয় শিক্ষা প্রচারে মনোনিবশন করে। রমজানের মতো পবিত্র দিনগুলোতে তাঁরা হারাম খাদ্য পরিবেশন করা শুরু করে কারখানা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। খাবার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাঁদেরকে লাঞ্ছিত করা হত। ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরও আক্রমণাত্মক পন্থা নেওয়া হয় নাস্তিকীয় শিক্ষা প্রচার করার জন্য। যদিও হোজ্জা বলেন যে, তিনি যে-কোনো সন্ত্রাসী পন্থা অবলম্বনের বিরোধী, তিনি চান বুঝিয়ে-শুনিয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে যে-কোনো অ্যাকশন গ্রহণের শক্ত ভিত গঠন করা হোক। এক্ষেত্রে তরুণদেরকে বেছে নেওয়া হয়। ২,১৮৯টি মসজিদ এবং চার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়। নাস্তিকবাদ অফিসিয়াল পলিসিতে পরিণত হয়। ধর্মীয় নামের শহর, নগরগুলোকে নতুন নাম দেওয়া হয়, ব্যক্তির নামও বদলে ফেলা হয়। ১৯৮২ মানুষের নামের ডিকশনারি বের করা হয়। যার মধ্যে ৩,০০০ সেকুলার নাম ছিল। এঁরা ক্ষমতায় আসার সময় ৩০০ খ্রিস্ট ছিলেন, যাঁদের মধ্যে মাত্র ৩০ জন প্রাণে বাঁচতে পেরেছিলেন। সমস্ত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই নাস্তিক দেশটিতে যাঁরা জন্ম নিয়েছিল তাঁরা ধর্মের ব্যপারে কিছুই জানত না। তাই তাই তাঁরা ছিল হয় নাস্তিক, নয়তো অ্যাগোনস্টিক।”
আনোয়ার হোজ্জাকে চিত্রায়িত করা হয় এমন একজন জিনিয়স হিসাবে যিনি কিনা সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সামরিক ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি নৈতিক উপদেশ দান করে গেছেন। প্রত্যেকটা স্কুলের বইতে সে যে বিষয়ের উপরই হোক না কেন তাঁর উক্তি উদ্ধৃত করা হত। এক আলবেনিয়ান তাই আক্ষেপ করে বলেছিলেন ফিজিক্সের ক্লাসে মাধ্যাকর্ষ শক্তির সূত্রটির জন্য কৃতিত্বটা পেতেন। হোজ্জা, যা ছিল নিউটনের পাওনা। আলবেনিয়া সিক্রেট পুলিশ এজেন্সি কেজিবির (কেজিবির পুরো নাম রুশ ভাষায় ‘কমিটেট গোসুডরস্তভেনয় বেজোপাসনোস্তি’। অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।) মতো সব ধরনের দমনমূলক পন্থা অবলম্বন করত। আলবেনিয়ার প্রতি তিনজন নাগরিকের একজনকে হয়তো লেবার ক্যাম্পে কাটাতে হত কিংবা সম্মুখীন হতে হত আলবেনিয়া সিক্রেট পুলিশ অফিসারদের জেরার টেবিলে। ভিন্ন মতালম্বীদের দমনের জন্য সিস্টেমেটিক সব পন্থা অবলম্বন করা হত। চাকুরিচ্যুত করা, লেবার ক্যাম্পে আটকে রাখা এবং প্রায়শই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া। সরকারি কর্মকর্তাদের সরকারি সফর ছাড়া কাউকে বিদেশ যেতে দেওয়া হত না। পশ্চিমা নাচ নিষিদ্ধ ছিল, শিল্পকর্মকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল সোসালিস্ট রিয়ালিজমের মধ্যে। ১৯৮১ সালে হোজ্জা অনেক পার্টির নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তাকে শুলে চড়ান। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শেহু এই সময় আত্মহত্যা করেন অন্তর্দলীয় কোন্দলের কারণে। এটি ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে হোজ্জা যখন মারা যান আলবেনিয়া তখন সারা বিশ্বের কাছে একটি নিষিদ্ধ দেশ, যাঁরা বহির্বিশ্বের কাছে থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁর শাসনামলের প্রায় সবটুকু জুড়েই আলবেনিয়া ছিল ইউরোপের সবচাইতে গরিব দেশ। ১৯৯০ সালে হোজ্জার প্রতিষ্ঠিত একদলীয় শাসনের অবসান ঘটে। ১৯৯২ সালে পরাজিত হয় সোসালিস্ট পার্টি। আজ আলবেনিয়া হোজ্জা লিগ্যাসির সামান্য কিছুই অবশিষ্ট আছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা জনগণকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও মজার ব্যপার আলবেনিয়া এখন ওআইসির সদস্য”। প্রকৃত ঘটনা যাচাই না-করেই এহেন ব্যতিক্রমী ঘটনাকে স্মরণ করে আস্তিক্যবাদীরা তৃপ্তি লাভ করেন।