ইসলামধর্ম, হিন্দুধর্ম, খ্রিস্টানধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলি হল শাসক মানুষের তৈরি।এই ধর্ম-সংস্থাগুলির সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলি এক-একটি গোষ্ঠীর এক-একটি দোকানমাত্র। ধর্ম-সংস্থাগুলির সঙ্গে ঈশ্বরকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে বলেই এত বিড়ম্বনা। শুধুমাত্র অন্য ধর্ম-সংস্থার আস্থাকারী বলেই আর-এক ধর্মের মানুষরা ধর্ষণ করে, খুন করে, উচ্ছেদ করে, বিতাড়িত করে দেশ থেকে। মর্মে অনুধাবন করার চেষ্টা করুন–ধর্ম-সংস্থাগুলি অনেকটা রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে তুলনীয়। ধর্ম-সংস্থাগুলি আসলেই এক-একটি রাজনৈতিক দল, শুধু নির্বাচনেই যা অংশগ্রহণ করে না। এই ভারতবর্ষের কথাই ধরুন-না এই মুহূর্তে ভারতে ১৭৬৬ টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে ৬টি জাতীয় রাজনৈতিক দল। ৬টি জাতীয় রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র দুটি রাজনৈতিক দল (ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টি) ভারতকে পালাক্রমে ডোমিনেট করে। অনুরূপ ভারতে গৌণ-অগৌণ মিলিয়ে অসংখ্য ধর্ম-সংস্থা আছে, তার মধ্যে দুটি ধর্মীয় সংস্থা ড্ডামিনেট করছে–একটি হিন্দু, অপরটি মুসলিম। ধর্ম রাজনৈতিক দলের মতো মতাদর্শের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন। আসলে ভিন্নতা বলতে তেমন কিছু নয়, ভিন্নতার ছদ্মবেশে আলাদা নেতৃত্বে গোষ্ঠীর উত্থান। মৌলিক কিছু ভিন্ন তা ছাড়া সবই এক –সবই মুদ্রার ওপিঠ আর এ পিঠ। কী ধর্ম-সংস্থা, কী রাজনৈতিক দল–সবখানেই গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে দ্বন্দ্ব, কোন্দল। রূপ আলাদা, মোটো এক–কর্তৃত্ব, ক্ষমতায়ন। ধর্মে ঈশ্বরকে জড়িয়ে ভণ্ডামি, রাজনীতিতে আর্দশের কথা বলে ভণ্ডামি। কার্ল সেগান বলেন, “বিশ্বাসীকে যুক্তি-তথ্যের সাহায্যে কিছু বোঝানো সম্ভব নয়; কারণ তাদের বিশ্বাস প্রমাণভিত্তিক নয়, বিশ্বাস করার গভীর প্রয়োজনীয়তার ভেতরেই তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি নিহিত।”
বিশ্বাস-নির্ভর ধর্মের প্রভাব গোটা বিশ্বজুড়ে। আমাদের রীতি-রেওয়াজ, আমাদের আইডেন্টিটি, বিয়ে-সাধী ইত্যাদি নানাবিধ সামাজিক উৎসব সবেতেই ধর্মের উপস্থিতি বহমান। ধর্ম একপ্রকার ভাইরাসের মতো। ভাইরাসকে টিকে থাকতে যেমন অসংখ্য ‘হোস্ট’-এর প্রয়োজন হয় বংশবৃদ্ধির জন্য, নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, ধর্মেরও ঠিক তেমনই অসংখ্য ‘এজেন্ট’-এর প্রয়োজন হয়। সেইসব এজেন্টরা কেউ গুরু, কেউ পুরোহিত, কেউ ইমাম, কেউ মৌলবি, কেউ পাদরি, কেউ-বা পোপ হিসাবে পরিচিত। এঁরা ঈশ্বর ও ঈশ্বরপ্রদত্ত ধর্মের বান্দা বা সেবক। ভাইরাসকে বেঁচে থাকতে যেমন একটি জীবন্ত শরীরের প্রয়োজন হয়, ধর্মকে বেঁচে থাকতেও অন্ধ ভক্তের প্রয়োজন হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় –“মানুষই দেবতা গড়ে তাহার কৃপার ‘পরে করে দেবমহিমা নির্ভর”।
বিশ্বাসের প্রভাবে বলীয়ান হয়ে মানুষ সেই প্রাচীনকাল থেকেই কুমারী হত্যা থেকে শুরু করে শিশু হত্যা করে কাল্পনিক ‘পরমকরুণাময়’-কে তুষ্ট করে গেছে, সতীদাহের নামে শত-সহস্র মহিলাকে জোর করে পুড়িয়ে মেরেছে, নাস্তিক ও বিধর্মীদের হত্যা করেছে, ধর্মের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ধর্মযুদ্ধ (Crusade) করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। বিশ্বাসের ভাইরাস প্রচণ্ড সংক্রামক। জীবাণু ভাইরাসকে ওষুধ বা ভ্যকাসিন দিয়ে দমন করতে সক্ষম হলেও ধর্মের ভাইরাস দমন করা সম্ভব হয়। কারণ রাষ্ট্রই ধর্মীয় ভাইরাসের মদতদাতা। তাই ফারাবীর মতো মৃত্যুর হুমকিদাতার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নিতে সাহস পায় না বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
কিন্তু নাস্তিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সর্বদাই খঙ্গহস্ত। নাস্তিকদের আদালতের তুলে এনে বিচার করা হয়, জেল হয়। নাস্তিকদের রচিত গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা হয়, নাস্তিকদের বই যেসব প্রকাশক প্রকাশ করে, তাঁদের হত্যা করা হয়। নাস্তিকদের লেখা বই পুড়িয়ে, তাঁদের বইকে নিষিদ্ধ করে যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তকদের প্রতিহত করার চেষ্টা নতুন কোনো প্রয়াস নয়। কথিত আছে, আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের বই ধ্বংস করতে গিয়ে ধর্মের ভাইরাস’ খলিফা
ওমর নাকি বলেছিলেন –“বইপত্রগুলো যদি কোরানের শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না-হয়, তবে সেগুলো আমাদের দৃষ্টিতে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। কাজেই ওগুলোর ধ্বংস অনিবার্য। আর বইগুলোতে যদি কোরানের শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কোনো কথাবার্তা আদৌ থেকেও থাকে, তবে তা হবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত। সেদিক থেকেও এই বইগুলো নষ্ট করে ফেলা সঠিক কাজ”। মুক্তচিন্তক হত্যা করা সম্ভব, আক্রমণ করা সম্ভব–কিন্তু মুক্তচিন্তকদের চিন্তাকে কোনদিন কোনোভাবেই বিনাশ করা যাবে না। মিখাইল বুলগাকভের ভাষায় –“পাণ্ডুলিপি পোড়ে না”।
কারোর কারোর মনে হয় যাঁরা ধর্মহীন যাঁরা ধর্ম মানে না তাঁরাই নাস্তিক। আর যাঁরা ধার্মিক বা ধর্ম মানে বলে জাহির করে, তাঁরাই আস্তিক। ধর্ম ব্যাপারটা কী? কোন ব্যাপারটাকে আমরা ধর্ম বলছি? কেধৰ্মমানে, কেই-বা ধর্ম মানে না! ধর্মহীন বলে কোনো প্রাণী এ পৃথিবীতে আছে নাকি? তাহলে? বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। সব গুলিয়ে গেছে। আসুন সটিং করে দেখি। ধর্মের রূপ দুই ধরনের। (১) ঈশ্বরজড়িত ব্যবস্থাএবং (২) জৈবিকজড়িত ব্যবস্থা।
(১) ঈশ্বরজড়িতব্যবস্থা : ঈশ্বরজড়িত ব্যবস্থা হল ঈশ্বর নামক এক কাল্পনিক অস্তিত্বকে সামনে রেখে জীবনচর্যা। পূজার্চনা, যাগযজ্ঞ, আচার-সংস্কার, মন্দির মসজিদ-গির্জাদির মতো উপাসনাগৃহ নির্মাণ ইত্যাদি ব্যবস্থাই ঈশ্বরজড়িত ধর্মীয় ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় মানুষ নিজের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ ছাড়া বাকি ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলিতে ব্রাত্য ভাবেন। এটাই আধ্যাত্ম ধর্ম বা Spritual Religion. (২) জৈবিকজড়িত ব্যবস্থা : জৈবিকজড়িত ব্যবস্থায় ঈশ্বরের কোনো স্থান নেই। এই নিয়মে পৃথিবীর বুকে যা যা অবস্থান করছে তার সবকিছুরই ধর্মআছে। সেদিক দিয়ে বিচার করলে ধর্মহীন কোনো বস্তু হয় না। “ধৃ’-ধাতুর উত্তরে মনিন প্রত্যয় করে ‘ধর্ম’ শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায় যা আমাদের ধারণ করে। শুধু মানুষ নয় –গাছপালা, পোকামাকড়, জন্তুজানোয়ার সবাই পালন করে। হেমন্তকালে গাছের পাতা ঝরে, এটা গাছের ধর্ম। ক্ষুধার্ত বাঘ যখন হরিণের পিছু নেয় ওটা বাঘের ধর্ম, আত্মরক্ষার জন্য হরিণের পলায়ণ সেটা হরিণের ধর্ম। মানুষসহ সমস্ত প্রাণীরা যৌন-তাড়নায় একে-অপরের শরীরে শরীর সংযোজন করে, সেটা প্রাণীদেহের জৈবিক ধর্ম। খিদে পেলে খাদ্যগ্রহণ করি, খাদ্যগ্রহণ করাটা ধর্ম। আমাদের প্রত্যেকের নিজের নিজের পথ চলার দিশা আছে আদর্শ আছে ফিলোসফি আছে –সেটাই ধর্ম।