সে যা-ই হোক না কেন, আমাকে যে মুখবুজে থাকলে চলবে না, আমার যে না বলে উপায় নেই।
আমার আড়ম্বরহীন ক্লান্ত বছরগুলো একটার পর একটা করে পেরিয়ে যেতে লাগল।
আমি তখনও বহু বর্ণের ঘাসের গালিচা বিছানো উপত্যকায় বসবাস করছি। কিন্তু আমার চারদিকের সবকিছুতেই দ্বিতীয় পরিবর্তনের ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেউপত্যকার সবুজ ঘাসের গালিচার রং ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে এসেছে। তারা ফুলগুলো আর ফোটে না, গাছগুলো শুকিয়ে গেছে। রক্তাভ এসকোডেল ঝরে পড়তে পড়তে নিঃশেষ হয়ে গেছে। কালো চোখের মতো ভায়োলেট ফুলের থোকা তার স্থান দখল করেছে। অতিকায় ফ্লেমিঙ্গো পাখিটা আর আমার চোখের সামনে দিয়ে লোহিত বর্ণের ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় না। সে উপত্যকাটা ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
আর সেই বীণার সুরের চেয়ে মৃদুমন্দ ইয়োলুসের বাতাস–একমাত্র ইলিওনোরার কণ্ঠস্বর আর যাবতীয় সুরের তুলনায় অনেক, অনেক বেশি স্বর্গীয়, তা-ও ক্রমে মিলিয়ে যেতে যেতে নিঃশেষ হয়ে গেল।
সব শেষে সে ঘন পুঞ্জীভূত মেঘও এক সময় পাহাড়ের শীর্ষদেশগুলোর আশ্রয় ছেড়ে সন্ধ্যাতারার দেশে পাড়ি জমিয়েছে, আর যাবতীয় রূপ-সৌন্দর্যকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল।
এতকিছু সত্ত্বেও ইলিওনোরা কিন্তু তার শপথ ভুলে যায়নি। উপত্যকার ওপর দিয়ে পবিত্র সুগন্ধে ভরপুর একটা ঢেউ বয়ে চলল। বহু নির্জন ক্ষণে বহু দীর্ঘশ্বাস বাতাসের সঙ্গে ভর করে আমার দুটোকে স্পর্শ করে যায়। শন শন ধ্বনিতে রাতের বাতাসকে ভরিয়ে তোলে। একটা বার, মাত্র একবার হায়! আর মাত্র একবার! তার দুটো অতীন্দ্রিয় ঠোঁট আমার ঠোঁট দুটোকে স্পর্শ করে আমার মৃত্যুর মতো গভীর ঘুমকে চটিয়ে দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল।
কিন্তু হায়! আমার বুকের হাহাকার আর হা-হুঁতাশ মিলিয়ে গিয়ে শূন্যতার তাতেও পূর্ণ হলো না। আমাকে এক সময় যে প্রেম ভাসিয়ে এক অচিন দেশে নিয়ে যেত, সে প্রেম ভালোবাসার জন্য আমি চাঞ্চল্য উপলব্ধি করতে লাগলাম।
শেষপর্যন্ত আমার পরিস্থিতি এমন হলো যে, ইলিওনোরা-র স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে উপত্যকার আশ্রয় আমার কাছে বিষাদক্লিষ্ট হয়ে দাঁড়াল।
অনন্যোপায় হয়ে একদিন বিশ্বের অসার বস্তু আর হৈহুল্লোড়মুখর জয়ের সন্ধানে চিরদিনের জন্য সে উপত্যকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে এলাম।
দীর্ঘদিনের পরিচিত পাহাড়, জঙ্গল আর উপত্যকার সম্পর্ক ত্যাগ করে বিচিত্র এক । শহরে এসে মাথা গুঁজলাম। সেখানকার কোলাহলমুখর পরিবেশ, চাকচিক্য আর আনন্দ সূৰ্ত্তি হয়তো আমার মধ্য থেকে উপত্যকার স্বপ্নরাজ্যকে নিঃশেষে মুছে দিতে পারত। রাজ-দরবারের জৌলুস নারীদের সম্মোহিনীরূপ সৌন্দৰ্য্য আমার মন-প্রাণ-যাবতীয় সড়াকে নেশাগ্রস্ত করে ফেলল। তবে আমার মন কিন্তু তখন অবধি তার শপথের প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রেখে চলেছে। তখনও রাতের অন্ধকারে, নিস্তব্ধতায় ইলিওনোরার উপস্থিতির ইঙ্গিত অনুভব করে চলেছি।
অকস্মাৎ সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। আমার চোখের সামনের পৃথিবীটা অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল। সে জ্বালাময়ী চিন্তা-ভাবনা আর ভয়ঙ্কর প্রলোভন আমাকে চারদিক থেকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরল। তার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে আমি আতঙ্কে মুষড়ে পড়লাম।
ব দূর, বহু দূরবর্তী এক অজানা অচেনা দেশ থেকে এক রূপসি যুবতি আমার দরজায় উপস্থিত হল। ব্যস, আমার ভীরু মন-প্রাণ সে মুহূর্তেই তার রূপের ডালির কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সঁপে দিলাম।
হ্যাঁ, সত্যি বলছি, ভালোবাসার এক আকুল লঘু ও ঘৃণ্য পূজার আবেগে উচ্ছ্বাসে অভিভূত হয়ে বিনাসংগ্রামে আমি তার চরণকমলে আত্মনিবেদন করে বসলাম।
হ্যাঁ, আমি তাকে বিয়ে করে ঘর বাঁধলাম। আমি শপথ ভঙ্গের সে নির্মম অভিসম্পাত নিজে বেঁচে মাথায় পেতে নিয়েছিলাম, তাকেও পরোয়া করলাম না। তবে এও সত্য যে, আমার মাথায় কিন্তু অভিশাপ নেমে আসেনি।
আরও মাত্র একবার–এবার রাতের অন্ধকারে নিঝুম-নিস্তব্ধতায়–আমার জাফরির ফাঁক-ফোকড় দিয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো যা আমাকে ভুলেছিল। সে দীর্ঘশ্বাস যেন কণ্ঠস্বরে পরিণত হল। সুপরিচিত মিষ্টি-মধুর স্বরে বলল, ঘুমোও শান্তিতে ঘুমোও। ব্যাপারটা এমন যে প্রেমের দেবতাই রাজ্য চালায়, তাঁরই অঙ্গুলি হেলনে রাজ্যের প্রতিটা কাজকর্ম চলে। তোমার অন্তরের প্রেমের মধ্যে এই মেগার্ড নামের মেয়েটাকে তুমি আপন করে নিয়েছ, ভালোবেসেছ। তারই মাধ্যমে ইলিওনোরার কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে তা থেকে তুমি মুক্তি পেয়ে গেছ। কেন! কেন মুক্তি পেয়েছ তা অমরালোকে তোমাকে জানানো হবে, এখানে নয়–এখন নয়।
উইলিয়াম উইলসন
উইলিয়াম উইলসন!
হ্যাঁ, এখনকার মতো মনে করা যাক, উইলিয়াম উইলসন আমার নাম।
এ মুহূর্তে আমার সামনে যে সাদা পাতাটা রয়েছে সেটার গায়ে আমার প্রকৃত নামটাকে লিখে কলঙ্কিত করার কিছুমাত্র আগ্রহও আমার নেই। আর সে নামটা তো আমার পরিবারের সদস্যদের চোখে অনেক অবজ্ঞা, অনেক বিতৃষ্ণা আর অনেক ভীতি সৃষ্টি করেছে। ক্রুদ্ধ বাতাস কি এসব অতুলনীয় অখ্যাতিকে পৃথিবীর প্রত্যন্ত কোণ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়নি।
হায় কী যে মারাত্মক, অবর্ণনীয় জাতিচ্যুৎ। সবার দ্বারা আমাকে পরিত্যক্ত হতে হয়েছে। পৃথিবীর আপামর জনগণের চোখে কি আজ তোমার পরিচয় মৃত জন নয়? তুমি কি মৃত বলে পরিচিত নও? পৃথিবীর মান সম্মান, রঙ-বেরঙের ফুলের মেলা আর রঙিন মুখ-স্বপ্ন থেকে কি তুমি নির্মমভাবে নির্বাসিত নও? ঘন কালো এক টুকরো জমাট-বাঁধা মেঘ কি তোমার বাসনা আর স্বর্গের মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীর সৃষ্টি করে না? হায়! আজ তুমি সবকিছু থেকে নির্মমভাবে বঞ্চিত।