একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সে বার কয়েক লাফালাফি দাপাদাপি করার পর অতর্কিতে বানরের মতো একটা লম্বা লাফ দিয়ে একেবারে রাজা মশাইয়ের মাথার ওপর চেপে বসল। হাত বাড়িয়ে ঝুলন্ত সেঁকলের প্রান্তটা ধরে অদ্ভুত কৌশলে বানরের মতোই ঝুলতে ঝুলতে কয়েক ফুট ওপরে উঠে গেল এবার হাতের জ্বলন্ত মশালটাকে উঁচু করে ধরে, পরমুহূর্তেই সেটাকে এদিক-ওদিক বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওরাং ওটাং-এর দলটাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল–হ্যাঁ, আমার অনুমান অভ্রান্ত। ওরা কারা তা আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারব, এবং বলে দিতে পারব।
হলঘরের সবাই এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার যোগাড় হলো। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়াল, হাসতে হাসতে এওর গায়ৈ লুটিয়ে পড়তে লাগল। আর বামন ভঁড়নিজে বার বার অদ্ভুত কৌশলে ও বিচিত্র স্বরে শিস দিতে লাগল।
ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে ঝুলন্ত শেঁকলটা একটামাত্র হেঁচকা টানে অনেকখানি ওপরে উঠে গেল। আর সেটার সঙ্গেই বিভ্রান্ত ও অস্থিরচিত্ত ওরাংওটাংও যন্ত্রচালিতের মতোই ওপরে উঠে গিয়ে বামনের মতোই ঝুলতে লাগল।
তারা তখন স্কাইলাইটা আর হলঘরটার মেঝের প্রায় মাঝামাঝি একটা জায়গায় বানরের মতোই ঝুলতে লাগল, থেকে থেকে দোলও খেতে লাগল।
বামন ভাঁড় তখনও কিন্তু তাদের আগের দূরত্বে অবস্থান করে হাতের জ্বলন্ত মশালটাকে তাদের দিকে হেলিয়ে ধরে রাখল। তার মশাল আর চোখ-মুখের ভাব ভঙ্গি এমন যেন তাদের পরিচয় জানার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ওরাংওটাংদের ঝুলন্ত অবস্থা আর মুখের ভঙ্গি চাক্ষুষ করে হলঘরের সবাই যেন বিস্ময়ে ভিমরি খাওয়ার যোগাড় হলো। মিনিট কয়েক কারো মুখেই কোনো কথা নেই। হলঘরে নেমে এলো যেন কবরখানারনিস্তব্ধতা। কেবলমাত্র একটা ফ্যাসফ্যাস শব্দ সে নিচ্ছিদ্র নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে থেকে থেকে ঘরময় চক্কর মারতে লাগল, রাজা মশাই। এবং তার সভাসদ মন্ত্রীরা আগেও যে-রকম শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। নীরব চাহনি মেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে সবাই উৎকর্ণ হয়ে শব্দটার উৎস সম্বন্ধে ধারণা নেবার চেষ্টা করল। শব্দটা যে কোথা থেকে আসছে, সে বিষয়ে এবার কারো মনে তিলমাত্র সন্দেহই রইল না। শব্দটার উৎসস্থল বামন ভাঁড়ের দাঁতের পাটি দুটো। সে দুটোর বার বার ঠোকাঠুকির ফলেই সে বিচিত্র শব্দটা সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহও রইল না। আর তার মুখ থেকে অনবরত ফেণা ঝরছে। রাজা মশাই আর
তার সভাসদ মন্ত্রীদের উলটে-থাকা মুখের দিকে কৌতূহলী অপলক চোখে তাকিয়ে রইল।
ক্রোধোন্মত্ত বামন ভাঁড় শেষমেষ বলে উঠল–উফ! যে! আঃ হা! বহু চেষ্টার পর এবার বুঝতে পারলাম, ওরা সত্যিকারের ওরাংওটাং নয়। আর এও বুঝতে পারলাম ওরা কারা।
পরমুহূর্তেই মশালটাকে রাজা মশাইয়ের গায়ের একেবারে কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে তার মুখটাকে ভালোভাবে দেখার ভান করতে লাগল। ব্যস, চোখের পলকে তার গায়ের ফোলানো ফাঁপানো শোন পাটের আঁশগুলোর গায়ে আগুন ধরে গিয়ে চোখের পলকে সবকিছু পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেল। আর ওরাংওটাংরূপী রাজা মশাই বানরের মতো তিড়িংবিড়িং করে লাফা-লাফি দাপাদাপি করতে লাগল।
এদিকে হলঘরে, নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তাদের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে হাহাকার হা-হুঁতাসে লিপ্ত হলো। সাধ থাকলে তাদের সামান্যতম সাহায্য করাও সম্ভব হলো না।
শেষপর্যন্ত মশালের আগুনের শিখা ক্রমে বাড়তে লাগলে বামন ভাঁড় উপায়ন্তর না দেখে শেঁকল বেয়ে উপরে উঠে আগুনের এলাকার বাইরে উঠে যেতে লাগল। পরিস্থিতি খারাপ বুঝে দর্শকরা কিছুক্ষণের জন্য আবার নীরব হয়ে গেল। সবাই একেবারে নির্বাক-নিস্তব্ধ।
বামন ভাঁড় সুযোগটার সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ল না। সে আবার মুখ খুলল–আমি কি বলছি, আপনারা ধৈর্য ধরে শুনুন।
দর্শকরা প্রায় সমস্বরে বলে উঠল কী? কী বলতে চাইছ?
মুখোশধারীরা কোন চরিত্রের মানুষ, এখন আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি।
ওরা কারা? কোন চরিত্রের মানুষ খোলসা করে বল।
ওদের মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং মহারাজা, আর অন্যান্যরা হচ্ছে তার সভাসদ– মন্ত্রী।
রাজা মশাই! আমাদের রাজা মশাই!
হ্যাঁ, ঠিক তাই। যে রাজা একটা অসহায় নিরীহ ম্র স্বভাবের মেয়েকে আঘাত করতে এতটুকুও কুণ্ঠিত হন না, আর সাত মন্ত্রীর চরিত্র এমনই যে, যারা এমন একটা জঘন্য অত্যাচাকে হাসিমুখে সমর্থন করেন।
এ কী অদ্ভুত কথা শোনাচ্ছ হে? আমাদের রাজা মশাই–
দর্শকদের কথার জবাব দিতে গিয়ে বামন ভাড় এবার অধিকতর দৃঢ়তার সঙ্গে বলল–হ্যাঁ, ঠিক তাই। যা বললাম, শতকরা একশো ভাগই সত্য। যাক গে, এবার আমার নিজের পরিচয় দিচ্ছি। সবাই শুনুন আমি নিজেই তো তোমাদের ভালোলাগা ভাড়, রসিকলাল।
আর এও শুনে রাখ, আমার সর্বশেষ তামাশা এটাই।
সে কী কথা হে! সর্বশেষ তামাশা বলছ কেন? তুমি কি আর—
না, আমি আর কোনোদিনই তামাশা দেখাতে উৎসাহি হব না।
বামন ভড়ের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই আলকাতরা আর শনপাট–অস্বাভাবিক দাহ্য পদার্থ দুটোর সংমিশ্রণে জ্বলন্ত আগুনে তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ হতে শুরু করল।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আট-আটটা ঝলসানো, আধ-পোড়া কালো মৃতদেহ শেঁকলের গায়ে ঝুলতে লাগল।
মৃতদেহগুলোকে লক্ষ্য করে পঙ্গু বামন ভঁড় রসিকলাল তার হাতের জ্বলন্ত মশালটা দুম্ করে ছুঁড়ে দিল। পরমুহূর্তেই বানরের মতো দ্রুত গতিতে সিলিং পর্যন্ত উঠে স্কাইলাইটের ভেতর দিয়ে চোখের পলকে লাপাত্তা হয়ে গেল।