বামন ভাঁড় রসিকলের ইচ্ছা ওরাংওটাংরূপী রাজা মশাই ও মন্ত্রিদের প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত একইভাবে, বৃত্তাকারে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে। উদ্দেশ্য, হৈ-হট্টগোলে মত্ত দর্শকরা হলঘরে ঢুকে কাণায় কাণায় ভর্তি করে ফেললে, পরিবেশ পুরোপুরি শান্ত স্বাভাবিক হয়ে এলে তবেই তাদের নাচের আসরে হাজির করা হবে।
আরাম-আয়েশে অভ্যস্ত রাজা মশাই ও মন্ত্রীরা দীর্ঘসময় ধরে একই জায়গায় কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থেকে থেকে আর ধৈর্য ধরতে পারছেন না। তার ওপর আলকাতরা আর শন পাটের আঁশগুলোও তাদের কর্ম বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল না। ফলে ঘড়িতে ঢং-ঢং করে দশটার ঘণ্টা বাজতেই তাদের ধৈর্যের বাঁধ পুরোপুরি ভেঙে গেল। সবাই ছুটাছুটি দাপাদাপি শুরু করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে শেঁকলে লাগল টান। ব্যস, তারা হুড়মুড় করে এ ওর ঘাড়ে পড়তে লাগল। আর বিকট স্বরে আর্তনাদও শুরু হয়ে গেল। তারপর শুরু হলো মেঝেতে রীতিমত গড়াগড়ি জড়াজড়ি আর মরিয়া হয়ে আর্তনাদ। সে এক বীভৎস দৃশ্য!
রাজা মশাই লক্ষ্য করলেন নাচিয়ে ওরাংওটাংদের মধ্যে উত্তেজনা চরম রূপ নিয়েছে আর খুশিতেও রীতিমত ডগমগ। তার মন আনন্দে নেচে উঠল।
বামন ভাঁড় যেমন ভেবেছিল, অদ্ভুতদর্শন হিংস্র জানোয়ারগুলোকে দর্শকরা ওরাং ওটাং ভাবুক আর না-ই ভাবুক অন্তত কোনো-না-কোনো জানোয়ার তো অবশ্যই ভাববে। কার্যত ঘটলও ঠিক তা-ই। মহিলারা এতগুলো হিংস্র জানোয়ারকে এক সঙ্গে দেখে কেবলমাত্র ভিত-সন্ত্রস্তই হয়ে পড়ল না, সবাই সম্বিৎ হারিয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ল।
মুহূর্তে পরিস্থিতি এমনই খারাপ হয়ে পড়ল যে, রাজা মশাইয়ের নির্দেশে মন্ত্রিরা যদি অস্ত্রপাতি গুদামে ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করে না রাখত, তবে হয়তো তাকে ভয়ঙ্কর একটা রক্তারক্তির দৃশ্যই চোখের সামনে দেখতেই হত। আর মন্ত্রী মহোদয়ের নিজেদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে নতুনতর চমকদার নাচ দেখার বাসনার প্রায়শ্চিত্ত করতে হত।
এদিকে দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে বাড়তে শেষপর্যন্ত চরম রূপ নিল। তারা প্রাণভরে ভিত-সন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে বাঁচার জন্য হলঘরের সদর-দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। হায়? এ কী সর্বনাশা ব্যাপার, দরজা যে বন্ধ! রাজা মশাইয়ের কড়া হুকুম দরজা যেন বন্ধ রাখা হয়। কোনো পরিস্থিতেই খোলা চলবে না। কেউ যদি তার এ আদেশ অমান্য করে তবে অবশ্যই তার গর্দান নেওয়া হবে। অতএব কার এমন বুকের পাটা যে, দরজা খুলবে। আর দরজাগুলোর চাবি বামন ভাঁড়ের জিম্মায়, টাকে গুঁজে রাখা হয়েছে।
একটু পরেই রাজা মশাই অদ্ভুত সাজে সজ্জিত সাত মন্ত্রীকে নিয়ে একেবারে জনপূর্ণ হলঘরটার কেন্দ্রস্থলে উপস্থিত হলেন।
এবার হৈ হট্টগোল আর চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। সবার মধ্যেই যেন পালিয়ে আত্মরক্ষার তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। আবার নিজের নিরাপত্তার জন্যও অনেকে অতিমাত্রায় ঠেলাঠেলি গুঁতোগুতি শুরু করে দিল। কারণ, ভিড়ের চাপে পায়ের তলায় পড়ে চ্যাপটা হওয়ার আশঙ্কাও কম নেই।
ঠিক তখনই সবাই একেবারে অভাবনীয় এক দৃশ্যের মুখোমুখি হলো। দেখা গেল, শেঁকল থেকে যে সুদৃশ্য ঝাড়বাতিটাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যেটাকে তখনকার মতো স্থানান্তরিত করা হয়েছে, সেটা ক্রমেই নিচে নামছে। সেটা নামতে নামতে তিন ফুটের মধ্যে নেমে এসেছে। পরে আর নামবে কি না তাই বা কে জানে?
এদিকে রাজা মশাই সাত মন্ত্রী–ওরাংওটাংদের নিয়ে হলঘরটা চক্কর মেরে কেন্দ্রস্থলে এসে হাজির হলেন, সে শেঁকলটা অবশ্যই হাতের নাগালের মধ্যে অবস্থান করছে। বামন ভঁড়টা তার আঁকা-বাঁকা পায়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে তাদের পিছন পিছন সর্বক্ষণ হাঁটাহাটি করতে করতে নানাভাবে উৎসাহিত করতে লাগল। এবার সে খুবই অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসল। ঝাড়বাতির শেঁকলটার সঙ্গে ওরাংওটাংদের বেঁধে রাখা শেঁকলের প্রান্ত দুটোকে যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুততার সঙ্গে বেঁধে দিল। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে শেঁকলে এমন টান লাগল যে, সাত-সাতটা জানোয়ারই অদ্ভুতভাবে শূন্যে ঝুলতে লাগল।
ইতিমধ্যে মুখোশ নৃত্যের দলটার ভয়-ভীতি অনেকাংশে হ্রাস পেয়ে গেছে। এতক্ষণে ওরাংওটাংরূপী মন্ত্রি মহোদয় নিশ্চিত হতে পেরেছেন, পুরো ব্যাপারটা একটা পরিকল্পনামাফিকই সম্পন্ন করা হচ্ছে। আর পরিকল্পনার মধ্য দিয়েই মজা আনন্দ লাভ সম্ভব হচ্ছে, আরও হয়তো হবে। এবার তারা আকস্মিক আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে অট্টহাসি হাসিতে ফেটে পড়ার যোগাড় হলেন। বামন ভাঁড় চেঁচিয়ে উঠল–ছেড়ে দাও, ওদের আমার হাতে ছেড়ে দাও। তার কর্কশ ও উচ্চগ্রামের কণ্ঠস্বর সবার কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে হলঘরের সর্বত্র ঘুরপাক খেতে লাগল–ওদের আমার হাতে ছেড়ে দাও।
তারপর সে আবার আগের মতো তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে উঠল–মনে হচ্ছে ওরা আমার পরিচিত, চিনি। মুখোশগুলো উঠিয়ে মুখগুলো দেখতে পারলেই নিঃসন্দেহ হতে পারব–ওরা কারা, কী-ই বা ওদের পরিচয়।
কথা বলতে বলতে সে অনবরত হাত-পা ছুঁড়ে ব্যাঙের মতো তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে ভিড় ঠেলে একেবারে দেওয়ালের কাছে চলে গেল। একেবারে ছো মেরে পরীর হাত থেকে জ্বলন্ত বড় মশালটাকে ছি নিয়ে নিয়ে একই রকমভাবে লাফাতে লাফাতে আগের জায়গাই ফিরে এলো।