ভড়ের কথা রাজা মশাই ক্রোধসম্বরণ করে শান্ত হলেন, স্বাভাবিকতা ফিরে পেলেন।
বামন রসিকলাল আর এক পেয়ালা মদ গলায় ঢেলে মুখোশনৃত্য পরিবেশনে মন দিল। তার মধ্যে কোনোরকম বেসামাল ভাবই দেখা গেল না।
এবার সে রাজা মশাইয়ের দিকে ফিরে করজোড়ে নিবেদন করল, মহারাজ, কি করে যে কি হয়ে গেল আমি ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। তবে মেয়েটাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে তার মুখে মদের পেয়ালা ঢেলে দেবার পরমুহূর্তেই, মহারাজ এ-কাজটা করলেন, আর খাঁচার কাকাতুয়াটা দরজার বাইরে থেকে অদ্ভুত শব্দটা করতে লাগল। আর তার ঠিক পরমুহূর্তেই আমার মধ্যে নতুন একটা ধারণা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আমাদের অনেক গ্রাম্য নৃত্যের মধ্যে একটা মুখোশনৃত্যের আসরে আমরা প্রয়ই সেটা দেখিয়ে থাকি। কিন্তু এখানে তো সেটাই একেবারে নতুন মনে হবে, ঠিক কি না?
রাজা প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলেন–হুম্!
কিন্তু রাজা মশাই দুর্ভাগ্যের বিষয়টা হচ্ছে, আটজন লোক না হলে যে নাচটা দেখানো সম্ভব নয়। মানে আটজন–
আরে ধ্যুৎ! তখন থেকে কেবল আটজন-আটজন করে যাচ্ছ। এই তো আমরাই আটজন হচ্ছি। এবার বল তো তোমার ওই নতুন নাচটার কি নাম?
নাম? মহারাজ, আমরা এটার নাম দিয়েছি, আট শৃঙ্খলিত ওরাংওটাং নাচ।
চমৎকার! চমৎকার নাচ! আমরাই অভিনয় করব।
নাচটার আসল মজাই হচ্ছে, নাচটা দেখে মেয়েরা যে ভয়ে কুঁকড়ে যাবে, তাতেই।
রাজা মশাই ও মন্ত্রীরা সমস্বরে বলে উঠলেন–চমৎকার! চমৎকার!
বামন ভঁড় এবার বলল–আপনারা ভাববেন না, আমিই আপনাদের ওরাংওটাং সাজিয়ে দেব। দেখবেন, আপনারা যেন এক-একটা সত্যিকারের ওরাংওটাং বনে গেছেন। সবাই ভাববে আপনারা আসল জন্তু। সবেমাত্র জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। তবে এও সত্য যে, আপনাদের দেখে সবাই যতটা ভয় পাবে, অবাকও হবে ঠিক ততটাই।
তার কথা শেষ হতে না হতেই রাজা মশাই সোল্লাসে বলে উঠলেন–চমৎকার! চমৎকার মতলব! রসিকলাল, আমি তোমাকে নিজে হাতে মানুষ মানুষ সাজিয়ে দেব। চমৎকার হবে তাই না?
বামন ভাঁড় বলে চলল–মহারাজ, সবার মধ্যে গোলমালটাকে বাড়িয়ে তোলার জন্যই শেঁকলগুলো ব্যবহার করা হবে যাতে অনবরত ঠুং-ঠাং-ঠুং-ঠাং আওয়াজ হয়। ব্যাপারটা এমন হয়ে উঠবে যে, সবাই ভাববে পাহারাদারদের জিম্মা থেকে আপনারা দলবেঁধে পালিয়ে এসেছেন। একটা মুখোশনৃত্যে শেঁকলবাধা আট-আটটা ওরাং ওটাংকে দেখে সবাই সত্যিকারের ওরাংওটাং বলে ভুল করে বসবে। তবে আপনারা সবাই বনের জানোয়ারের মতো হরদম তর্জন গর্জন করতে থাকবেন। আর ছুটতে ছুটতে এসে দামি ও চকচকে পোশাক পরিহিত নারী পুরুষদের ভিড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাফালাফি দাপাদাপি শুরু করে দেবেন। কী মজা
রাজা মশাই বলে উঠলেন তা-তো হবেই–হতে বাধ্য।
বামন ভাঁড়ের মুখোশনৃত্যে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য মন্ত্রীরানিজনিজ আসন ছেড়ে উঠে এলেন।
বামন ভাড় রসিকলাল ব্যস্ত-হাতে অল্পক্ষণের মধ্যেই তাদের প্রত্যেককে ওরাং ওটাং সাজিয়ে দিল। জব্বর সাজ হয়েছে। সবাই বলবে, সবে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছেন?
আসলে ব্যাপারটা ভালোই দাঁড়াল। এখানে সে সময়কার এবং সে অঞ্চলের গল্পের অবতারনা করা হচ্ছে বিশেষ করে সেখানকার মানুষ ওরাংওটাং নামধারী বিচিত্র ধরনের জানোয়ার বড় একটা চোখে দেখেছে। আর যেহেতু বামন ভাড় অতিমাত্রায় রং ব্যবহারের মাধমে তাঁদেও এক-একটা বীভৎস জানোয়ারের রূপদান করেছে, তাতে কারে সন্দেহ করার কথাই নয় যে, সবাই সত্যিকারের ওরাংওটাং নয়। অতএব দর্শকরা চোখের সামনে এতগুলো অদ্ভুতদর্শন জানোয়ার দেখতে পেয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। তার ওপর বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে যখন মুখোশনৃত্যের নামে তাণ্ডবনৃত্যে মেতে উঠবে তখন তাকে তারা পুলকানন্দে যে মাতোয়ারা হয়ে উঠবে আশ্চর্য কি?
এখন ওরাংওটাংরূপী রাজা মশাই ও মন্ত্রীদের সাজগোজের ব্যাপারটা সম্বন্ধে একটু-আধটু আভাস দেওয়া যাক। বামন ভাড় রসিকলাল প্রথমেই তাদের সবার গায়ে মোজার কাপড়ের তৈরি একটা করে আঁটসাঁট শার্ট। তার ওপর পড়েছে একই রকম আঁটসাট পা-জামা। এবার তাদের গায়ে আচ্ছা করে আলকাতরা মাখিয়ে দেওয়া হলো শরীরের কোথাও এতটুকুও ফাঁক রাখা হলো না।
উপস্থিত দর্শকদের দু-একজন আলকাতরার ওপর পাখির ছোট ছোট পালক সেঁটে দেওয়ার পরামর্শ দেয়। বামন ভাঁড় কিন্তু সে পথেই গেল না। সে একগাট্টি শন পাটের ধবধবে আঁশ নিয়ে এলো। হাত দিয়ে সেগুলোকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিয়ে সবার গায়ে সেঁটে দিল শন-পাটের আঁশে আলকাতরার প্রলেপ পুরোপুরি চাপা পড়ে গেল। ফলে তারা প্রত্যেকে যেন এক-একটা অবিকল লোমশ জানোয়ারে পরিণত হয়ে গেল। বেড়ে মতলব, চমৎকার সাজ।
এবার লোহার লম্বা শেঁকল দিয়ে সবাইকে এমন করে জড়িয়ে দেওয়া হলো যাতে চলাফেরা ও লাফালাফি দাপাদাপি করতে অসুবিধা না হয়। উপরন্তু নাচের সময় শেঁকলে-শেঁকলে তো লেগে ঠুং-ঠাং আওয়াজ করবে।
শেঁকল দিয়ে বাঁধার পর্ব সেরে বামন ভাঁড় এবার সবাইকে বৃত্তাকারে দাঁড় করিয়ে দিল। পুরো ব্যাপারটা যাতে স্বাভাবিক বলে সবাই ভেবে নিতে পারে সে জন্য শেঁকলের প্রান্ত দুটোকে বৃত্তের মধ্যে নিয়ে এসে একটা খুঁটির সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হলো। ব্যাপারটা এখন এমন দাঁড়াল যে, জঙ্গল থেকে ওরাংওটাংদের পাকড়াও করে নিয়ে এসে এখানে খুঁটিটার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। আবার এও ভাবা যেতে পারে, সম্প্রতিকালে বোণিওতে সিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং এবং অন্য জানোয়ারদের ধরার জন্য যেভাবে ফাঁদ তেরি করা হয় এও ঠিক সে-ব্যবস্থাই করা হয়েছে। বোর্ণিও ছাড়া অন্য কয়েকটা দেশে বানর ও হনুমান প্রভৃতি প্রাণীদের ধরার জন্যও এই একই পদ্ধতিতে ফাঁদ তৈরি করে তাদের পাকড়াও করা হয়।