বামন রসিকলাল ক্ষণিক ইতস্ততের পর মদের পেয়ালাটা গলায় ঢালা মাত্র রাজা মশাই গলা ছেড়ে হো-হো রবে হেসে উঠছিলেন। এখন আবার আগের মতোই হাসতে হাসতে বললেন–কি হে, রসিকলাল, কি হে, এক পেয়ালা মদের কেমন খেল্ দেখলে তো? আয়নার কাছে গিয়ে দেখে নিতে পার, এরই মধ্যে তোমার চোখ দুটো কেমন লাল হয়ে উঠেছে, আর কেমন ঝিল্লা দিচ্ছে!
হায়রে হতভাগা বামন। মদের গুণে ঝিল্লা দিচ্ছে, নাকি চোখের জলে মোমবাতির আলো পড়ে চকচক করছে! সে কাঁপা কাঁপা হাতে পেয়ালাটা টেবিলের ওপর রেখে দিল। এবার প্রায়-উন্মাদের মতো চাহনি মেলে রাজা মশাই ও তার পাশে অবস্থানরত। মন্ত্রী মহোদয়ের দিকে চোখের মণি দুটোকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাল।
এদিকে রাজা মশাই রসিকতায় সাফল্য লাভ করেছেন দেখে সবার মনই আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠল।
ইয়া পেল্লাই ভুঁড়ি ও নাদুসনুদুস চেহারাধারী মন্ত্রি মহোদয় বিশ্রি স্বরে ফিকফিক করে হেসে বলল–আর দেরি কেন হে বামন দেব, তোমার খেলা আবার শুরু করে দাও।
অবশ্যই, অবশ্যই; এগিয়ে এসো হে রসিকলাল, আমাদের একটু সাহায্য কর। অদ্ভুত অদ্ভুত চরিত্র আমরা দেখতে চাই। নাও, শুরু করে দাও তোমার কেরামতি।
সাত-সাতজন মন্ত্রী সমস্বরে হেসে উঠল। সে কী বিকট হাসি! রসিকলালও নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে ক্ষীণস্বরে হলেও অর্থপূর্ণ হাসি হাসতে লাগল।
রাজা মশাইয়ের ধৈর্যচ্যুতি ঘটার যোগার হলো। তিনি বলে উঠলেন–তুমি যে খুব গড়িমশি শুরু করলে হে রসিকলাল! তোমার মতলবটা শুনি? তামাসা দেখাবার মতো তোমার মধ্যে কি কিছুই নেই। তুমি তো অবাক করলে হে!
মদের নেশা রসিকলালকে রীতিমত জেঁকে ধরেছে। সে নেশার ঘোরটাকে একটু সামলে নিয়ে কোনোরকমে জবাব দিল–রাজা মশাই আমি কিন্তু শুধু শুধু গোমড়া হয়ে বসে নেই।
তবে? মুখে কলুপ এঁটে–।
আমি নতুন কোনোকিছুর কথাই বলছি কিন্তু মহারাজ।
নতুন কিছু। স্বেচ্ছাচারী রাজা গুলি-খাওয়া বাঘের মতো হিংস্র স্বরে গর্জে উঠলেন–বহুৎ আচ্ছা! তোমার মতলবটা কি? বলতেই বা চাচ্ছ কি, শুনি? উফ! এবার ব্যাপারটা খোলসা হয়েছে। মদ আরও মদ চাচ্ছ, তাই না?
রাজা মশাই মদভর্তি আর একটা পেয়ালা পঙ্গু বামন ভঁড় রসিকলালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন–এই যে, নাও–গেল!
মদের পেয়ালাটার দিকে সে কিন্তু হাঁ করে তাকিয়েই রইল। আর ঘোঁৎ ঘোৎ করে শ্বাস নিতে লাগল।
ক্রোধোন্মত্ত রাজা মশাই অধিকতর হিংস্র স্বরে গর্জে উঠলেন–নাও, ধর বলছি! শয়তানের দিব্যি দিয়ে বলছি, তার ক্রোধ মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় কথাটা আর তার পক্ষে শেষ করা সম্ভব হলো না।
বামন ভাড় আগের মতোই ইতস্তত করতে লাগল।
রাজা রেখে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন।
মন্ত্রি ও অন্যান্য সভাসদদের মুখে ফুটে উঠল বিদ্রুপের হাসি। ত্রিপেত্তা এতক্ষণ রসিকলালের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে ব্যাপার স্যাপার দেখছিল। ক্রমে তার মুখটা মড়ার মতো ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। পরিস্থিতি প্রতিকূল অনুমান করে সে সিংহাসনের দিকে দুপা এগিয়ে গিয়ে নতজানু হয়ে অভিবাদন করে করজোড়ে মিনতি করল–মহারাজ, এ-অধমের অপরাধ মার্জনা করে দিন।
তার ঊদ্ধত্যে রাজা মশাই যেন একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। বিস্ময় মাখানো দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলেন। কি করা ও বলা উচিত, কীভাবে রাজার উপযুক্ত ক্ষোভ প্রকাশ করবেন তা মুহূর্তের মধ্যে ভেবে উঠতে পারলেন না। শেষমেশ মুখে টু-শব্দটিও না করে উত্তেজনায় ফুঁসতে ফুঁসতে সজোরে এক ধাক্কা মেরে ত্রিপেত্তাকে দূরে ঠেলে দিলেন। তারপরই পেয়ালার সবটুকু মদ তার মুখে ঢেলে দিয়ে ক্রোধে ফুঁসতে লাগলেন।
বেগতিক দেখে রূপসি বেঁটে মেয়েটা কোনো কথা না বলে দ্রুত টেবিলের তলায় তার নিজের জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিল। মুখে একটা কথাও বলল না।
মুহূর্তের মধ্যেই বিশাল সভাপ্রাঙ্গণে নেমে এলো শ্মশানের নীরবতা। পরমুহূর্তেই সে নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে একটা খুবই মৃদু অথচ কর্কশ খস্ খস্ শব্দ সবার কানে এলো।
রাজা মশাই ভঁড় বামন রসিকলালের দিকে তর্জনি তুলে চিৎকার করে উঠলেন– তুমি কেন এমন বিশ্রি শব্দ করছ? কেন? কেন? কেন আমি জানতে চাই।
ভাঁড় বামনটার হাবভাব দেখে মনে হলো তার মদের ঘোর অনেকটাই কেটে গেছে। নিস্পলক চোখে স্বেচ্ছাচারী রাজার দিকে তাকিয়ে বলল–আমি? আমি শব্দ করেছি, বলছে? কিন্তু আমি কেন শব্দ করতে যাব, বলুন তো রাজা মশাই?
সভাসদদের মধ্য থেকে একজন কিছু সময় উকৰ্ণ হয়ে শব্দটা শোনার পর আমতা আমতা করে বললেন–না, শব্দটা বাইরে থেকেই ভেসে আসছে মনে হচ্ছে। মুহূর্তের জন্য নীরবে লক্ষ্য করে এবার বললেন–মহারাজ, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, জানালার কাছে খাঁচায় বসে হতচ্ছাড়া কাকাতুয়াটা তারের গায়ে শক্ত ঠোঁটটা ঘষে ঘষে শান দিচ্ছে। শব্দটা শুনে তো এটাই মনে হচ্ছে।
কথাটা শুনে মোটামুটি আশ্বস্ত হয়ে রাজা মশাই–তাই নাকি? আমি কিন্তু শপথ করে বলতে পারতাম শব্দটা নির্ঘাৎ এ-হতচ্ছাড়াটার দাঁতের শব্দ।
কথাটা কানে যেতেই বামন ভাড় ফিক করে হেসে ফেলল। রাজা মশাই একজন হাস্যরসিক। কারও হাসিতে তার তো আপত্তি করা শোভা পায় না। ঠিক সে মুহূর্তেই তার মুখ থেকে একপাটি বড় আর বিশ্রি দাঁত বেরিয়ে এলো। আর সে সঙ্গে সে যতখুশি মদ খাওয়ার বাসনা প্রকাশ করল।