রসিকলালের পক্ষে ইচ্ছা থাকলেও ত্রিপেত্তাকে তেমন কিছু সাহায্য করতে পারত না। তবে তাকে সাহায্যের দরকারও তেমন পড়ত না। কারন নিজের প্রভাব প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়েই যে নিজের একটু-আধটু সমস্যা থাকলে অনায়াসেই দূর করতে তো পারতই বরং প্রয়োজন সে-ই সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে রসিকোল সমস্যামুক্ত করত। এভাবে তারা পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সুখেই দিন গুজরান করতে লাগল।
তবে দেখা যেত ত্রিপেত্তা প্রয়োজনে রসিকলালকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করত।
উপলক্ষটা আমার পক্ষে এখন আর বলা সম্ভব নয়, ভুলেও গেছি। রাজা মশাই একবার এক মুখো, নৃত্যের আয়োজন করেছিলেন। রীতিমত জাঁকজমকপূর্ণ মুখোশনৃত্য। আর আমাদের রাজপ্রাসাদে মুখোশনৃত্য মানেই ছিল রসিকলাল আর ত্রিপেত্তা-র নাচ। নাচের আসরে যারাই নাচুক না কেন, তাদের দুজনকে নাচতে হবেই, হবে। তাদের নাচছাড়া প্রাসাদে মুখোশ নাচ? অসম্ভব! রাজা মশাই-ই কেবল নন, মন্ত্রীরাও যে এমন অসম্ভব কথা ভাবতেই পারেন না। এতে রসিকলাল-এর পটুত্ব বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল। তার বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি সহকারে নাচার বহর দেখে সব বয়সী। আর রুচিশীল মানুষই একেবারে থ বনে যেত। যাকে বলে একেবারে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অপলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকত।
উৎসবের দিন এগিয়ে এসেছে। চারদিকে দারুণ তোড়জোড় চলতে লাগল। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলেই বামন নর্তকী ত্রিপেত্তার চোখের সামনেই প্রাসাদের সুবিশাল হলটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে ঝলমলে করে তোলা হলো। আর মুখোশনৃত্যের জন্য যেমন সষ্টি করা দরকার সেদিকে দক্ষ শিল্পীদের নজর কম ছিল না।
প্রকৃতির কোলে একমটু একটু করে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করেছে। হলঘরে দর্শকদের ভিড় যেন উপছে পড়ছে। সবাই প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে প্রতিটা মুহূর্ত কাটাচ্ছে।
কর্মকর্তাদের ব্যস্ততার অন্ত নেই। কেউই হাত-পা গুটিয়ে নিশ্চন্ত হয়ে বসে নেই, কারণে-অকারণে ছোটাছুতি মত্ত। কেবলমাত্র রাজা মশাই আর তাঁর সাত মন্ত্রির চোখে মুখে ইতস্ততের ছাপ থাকলেও ব্যস্ততার কোন চিহ্নই নেই। কিন্তু কেন যে তারা এমন ইতস্তত করছিলেন তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে এটা কারণ হলে হতেও পারে, অস্বাভাবিক স্থূলদেহী আর জালার মতো ইয়া পেল্লাই ভুঁড়ির অধিকারী হওয়ার জন্যই মনস্থির করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। আর এরই ফলে হয়তো বা তারা চেয়ার আঁকড়ে স্থবিরের মতো নিশ্চল-নিথরভাবে মুখোশ নাচ শুরুর প্রতীক্ষায় বসে ছিল।
এদিকে নাচ শুরু হবার নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও সবাই কেবল ছুটোছুটিতেই ব্যস্ত দেখে রাজা মশাই অনন্যোপায় হয়ে রসিকলাল আর ত্রিপেত্তাকে তলব করে পাঠালেন। এ বিপদের সময় তারাই যে শেষ সম্বল, একমাত্র ভরসা।
রাজা মশাইয়ের তলব পেয়ে তারা ব্যস্ত পায়ে রাজসভায় উপস্থিত হয়ে তাঁকে। অভিবাদন সেরে আদেশের প্রতীক্ষায় করজোড়ে দাঁড়িয়ে রইল।
রাজা মশাই তার সভাসদ সাত মন্ত্রিকে নিয়ে মৌজ করে এরে পর এক মদের পেয়ালা উজাড় করে চলেছেন।
রসিকলাল আর ত্রিপেত্তা রাজা মশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝে নিলেন, তার মেজাজ মর্জি মোটেই ভালো নয়।
রাজা মশাই ভালোই জানেন, রসিকলাল মদ পছন্দ করে না, এমনকি স্পর্শও করে না। দু-চার বার জোর করে মদের পেয়ালা তার গলায় ঢেলে দিয়ে লক্ষ্য করেছেন, মদ পেটে পড়ামাত্র পঙ্গু লোকটা প্রায় উন্মাদশা হয়। চিৎকার করতে তিড়িং বিড়িং করে অনবরত লাফাতেই থাকে। উন্মত্ততা তো অবশ্যই সুখকর নয়।
তবে এ-কথা খুবই সত্য যে, রসিকালের বাস্তব রসসিক্ত কথাগুলো রাজা মশাইয়ের খুবই প্রিয়। সে যখন রসাল দিয়ে দিয়ে কথা বলে তখন তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় বসে সুস্থিরভাবে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা শুনতে পারেন। তার মধ্যে এতটুকুও বিরক্তি প্রকাশ পায় না। তবে তার মেজাজ চাঙা করে তোলার জন্য রাজা মশাই জোর করে দু-চারবার তার গলায় মদের পেয়ালা ঢেলে দিয়েছিলেন।
রসিকলাল সঙ্গীনীকে নিয়ে রাজসভায় ঢুকে অভিবাদন সেরে করজোড়ে সামনে দাঁড়াতেই রাজা মশাই ঠোঁট থেকে মদের পেয়ালাটা নামিয়ে বললেন–এই যে রসিকলাল, তোমার অনুপস্থিত বন্ধুবান্ধবদের স্বাস্থ্যরক্ষার তাগিদে এক পেয়ালা গলায় ঢেলে নিয়ে মেজাজটাকে একটু চাঙা করে নাও।
রসিকলাল মুচকি হেসে আবার নতজানু হয়ে অভিবাদন সারল। রাজা মশাই পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে এবার বললেন নাও হে, দেরি করো না। মদ গিলে চাঙা হয়ে নিয়ে দু-একটা নতুন খেল দেখাও তো। একেবারে নতুন চরিত্র যা সচরাচর দেখা যায় না–দেখাও। সাফ কথা শোন, একঘেয়ে রঙরসের কথা আর অভিনয় দেখে দেখে অশ্রদ্ধা ধরে গেছে। নতুন কিছু চাই।
মদের পেয়ালাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে এবার বললেন, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? হাত বাড়াও, নাও ধর। এক ঢোক গিলেলেই দেখবে, ভেতরটা চনম নিয়ে উঠেছে, বুদ্ধি খোলতাই হয়ে যাবে। নাও–ধর।
পাওয়ার প্রতি বামন রসিকলাল-এর তেমন আগ্রহ না থাকলেও তা পেয়ে যাওয়ায় প্রত্যাখ্যান করতে উৎসাহি হলো না। হাত বাড়িয়ে পেয়ালাটা নিয়ে সোজা গলায় ঢেলে দিল। এবার রাজা মশাইয়ের হুকুম তামিল করতে গিয়ে কয়েকটা তামাসা দেখাবার চেষ্টা করল, কিন্তু মনের মতো করে পরিবেশন করতে পারল না, জমলও না মোটেই। আসলে সে তারিখটা ছিল অদৃষ্টবিড়ম্বিত ভাঁড়ের জন্মদিন। রাজা মশাইয়ের মুখে অনুপস্থিত বন্ধু-বান্ধবদের স্বাস্থ্যপান করার কথাটা শোনামাত্র তার মনটা হঠাৎ বিষিয়ে যায়, দুচোখ ভরে পানি আসে। তাই সে রাজা মশাইয়ের হাত থেকে মদের পেয়ালাটা নিয়ে তাতে অনেকগুলো ফোঁটা চোখের পানি ফেলেছিল।