যে আমলের কথা বলছি, তখন বামন ও ভাঁড় দুই রাজসভার শোভা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি করত। তাই সমাদরও পেত সবচেয়ে বেশিই।
আসলে একজন সত্যিকারের ভাড় অর্থাৎ হাস্যরসিকের সঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রাণখুলে হাসার একজন পঙ্গু অর্থাৎ অষ্টাবক্র মানুষকে দেখে তার চলাফেরা লক্ষ্য করে হাসিতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠা ছাড়া রাজা মশাইকে দিন কাটাতে হবে এ-কথা তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না।
কিন্তু আমি তো একটু আগেই বলে রেখেছি, হাস্যরসিকদের নব্বই শতাংশই হচ্ছে রীতিমত স্থূলদেহী, গোলাকার আর একটু আধটু গোবরগণেশ গোছের মানুষ। তাই তো একাধারে তিনগুণের অধিকারী আমাদের রাজা মশাইয়ের সভার ভাড় রসিক লাল-কে নিয়ে রাজা মশাই মহানন্দেই দিন কাটাচ্ছিলেন। হাসিখুশির মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে পারলে একজন আমুদে মানুষের আর কী-ই বা চাইবার থাকতে পারে।
রসিকলাল নামটা গীর্জার পুরোহিত দীক্ষান্তকালে বিদুষকের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন বলে আমার মনে হয় না।নির্ঘাৎ অন্য কোনো কারণ এর পিছনে ছিল। হ্যাঁ, কোনো-না-কোনো কারণ তো অবশ্যই ছিল। কি সে কারণ, তাই না? অন্য দশজন স্বাভাবিক লোকের মতো হাঁটাহাঁটি করতে অক্ষম, অষ্টাবক্রদেহে এঁকে বেঁকে হাঁটাচলা করত বলে রাজসভার সাত মন্ত্রীই আলোচনার মাধ্যমে একমত হয়ে তার নামকরণ করেছিল রসিকলাল।
সত্যি করে বলতে গেলে, রসিকলাল বিচিত্র এক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে হাঁটাচলা করত। তার চলার ভঙ্গিটা ছিল সত্যি অদ্ভুত লাফিয়ে সে চলত, এমন কথা বলা যায় না। আবার চলার সময় শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে চলত এমন কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে? এ-দুয়ের মাঝামাঝি এমন এক চোখে লাগার মতো ভঙ্গিতে সে হাঁটাচলা করত যাকে বলাচলে উপরোক্ত ভঙ্গি দুটোর মাঝামাঝি একটা ভঙ্গি।
কোনো কথা বলা বা হাস্যরসসিক্ত কথা বলে কারো মধ্যে হাসির উদ্রেক ঘটানোর দরকার তার হতো না। সে তারনিজস্ব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পথ পাড়ি দিচ্ছে দেখলেই পথচারীরা হেসে গড়াগড়ি যাবার জোগাড় হতো।
তাই তো রাজসভার ভাঁড় রসিকলাল বিশাল বপু, জালার মতো ইয়া বড় ভুঁড়ি আর অস্বাভাবিক বড় মাথার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সে ছিল রাজ্যসভায় রাজা মশাইয়ের একমাত্র সান্ত্বনা, একমাত্র নির্ভরস্থল।
কথাটা খুবই সত্য যে, বিকৃত পা দুটোর সাহায্যে চলাফেরা করতে তার খুবই কষ্ট স্বীকার করতে হতো। হবার কথাও তো বটে। এমন অষ্টাবক্র পা দুটোর সাহায্যে পথ পাড়ি দেওয়া, কম কথা। তবে সৃষ্টিকর্তা বিধাতা-পুরুষও কিন্তু তার এ ভয়ানক সমস্যাটা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসিন ছিলেন না। সে যাতে পায়ের সমস্যা থেকে কিছুটা অন্তত অব্যাহতি পেতে পারে সে কথা বিবেচনা করে হাত বাহু দুটোকে সাধারণের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি পেশীবহুল এবং অমিত শক্তির আধার করে তৈরি করে দিয়েছেন। কেন? পায়ের সমস্যা দূর করতে হাতের শক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজন কি? আছে, প্রয়োজন অবশ্যই আছে। এর পিছনে যুক্তি হচ্ছে, হাত দুটোর ওপর নির্ভর করে সে যাতে মই বা ঝুলন্ত দড়ি-বেয়ে অনায়াসেই ওঠা-নামা এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতে পারে তার জন্য হাতের শক্তিসামর্থ্য, তো একটু বেশি মাত্রায়ই দরকার।
আর দড়ির মাধ্যমে চলাফেরায় রসিকলাল অভাবনীয় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। কার্যত দেখা গেল, চলাফেরার ব্যাপারে তার ব্যাঙের চেয়ে অনেক বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যেত বানর, হনুমান আর কাঠবিড়ালীর সঙ্গেই। গাছে চড়ার কাজে সে ছিল স্বাভাবিক হাত-পাওয়ালা মানুষের চেয়েও অনেক বেশি পটু–ওস্তাদ।
রসিকলালের জন্ম কোথায় হয়েছিল, কোন্ দেশ থেকে যে সে এখানে উদয় হয়েছিল আমি কেন, সে অঞ্চলের কারোই জানা ছিল না। তবে জিজ্ঞাসাবাদ করে যেটুকু জানা সম্ভব হয়েছিল, আমাদের রাজার প্রাসাদ থেকে বহু যোজন দূরবর্তী এমন কোনো এক অসভ্য জংলিদের দেশ থেকে এসে সেখানে উদয় হয়েছিল যার নাম বাপের জন্মেও কেউ কোনোদিন শোনেনি।
রাজা মশাইয়ের সেনাপতিরা রসিকলাল আর তার চেয়ে সামান্য বেঁটেখাটো ও নৃত্য পটিরসী এক কিশোরীকে জোর জবরদস্তি ধরে এনে তার পায়ে নিবেদন করে উপহার দিয়েছিল।
এমন চমৎকার লোভনীয় উপহার পেয়ে রাজা মশাই যে মন্ত্রিদের ওপর খুবই প্রীত হয়েছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ব্যস, সেদিন থেকেই দুই ক্ষুদে নারী-পুরুষ রাজপ্রাসাদে বন্দি হয়ে গেল। এখানে কাছাকাছি-পাশাপাশি বন্দি জীবনযাপন করতে করতে তাদের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠবে তাতে অবাক হবার কোনো কারণই থাকতে পারে না। আর এভাবেই ক্রমে তারা একে অন্যের দারুণ কাছাকাছি চলে গেল। বন্ধু হয়ে উঠল।
আরে ধুৎ–! কথায় কথায় মাত্রাতিরিক্ত বেঁটেখাটো কিশোরিটার নামটাই তো বলা হয়ে উঠল না। যাক, তার নাম ছিল ত্রিপেত্তা। রসিকলালের বান্ধবী ত্রিপেত্তাও রাজপ্রাসাদের মানুষগুলোর কাছে কম আদরণীয় ছিল না। কারণ, ত্রিপেত্তা বামন ছিল ঠিকই। তবে এও সত্য যে, বামন হলেও ত্রিপেত্তার রূপ-লাবণ্য ছিল বাস্তববিকই অতুলনীয়। এক ঝলক দেখলেই মোহিত হয়ে যেতে হতো, চোখে বাধা লেগে যাবার যোগাড় হতো। তাই তো রূপসি কিশোরী সবার চোখেই আদরনীয় ছিল। আর এ কারণেই রাজসভায় তার প্রভাব বাড়তে বাড়তে একেবারে তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল।