এবার আমরা অগ্রসর হতে লাগলাম মি. ফরসাইথের ডায়রির পাতায় যেখানে তিনি মি. আইন্সওয়ার্থ আর মি. মংক ম্যাসনের যৌথ ভাবে লেখা পাণ্ডুলিপিকে অবিকল অনূদিত করেছেন। ভাষান্তরিত বিবরণীয় সাহায্য নেওয়া ছাড়া আমাদের তো গতিও নেই। ডায়েরিটা মি. ম্যাসন নিজে হাতে লিখেছেন। আর প্রতিদিনই মি. আইন্সওয়ার্থ তার পাতায় পুন: উল্লেখ করে কিছু-না-কিছু সংযোজন করেছেন।
কেবলমাত্র এ-ই নয়, তার সঙ্গে তিনি এ সমুদ্রযাত্রার একটা বিস্ময় সষ্টিকারী মনোজ্ঞ বিবরণও তৈরি করে ফেলেছেন। সত্যি কথা বলতে কী, সে বিবরণীয় পাঠ করলে অতি বড় নীরস পাঠক-পাঠিকার মন-প্রাণ পুলকানন্দে মেতে ওঠারই কথা। আর অত্যল্পকালের মধ্যেই আমরা সে অনন্য বিবরণী সর্বসাধারণের হাতে তুলে দিতে পারব বলেই বিশ্বাস রাখি।
হপ ফ্রগ
আমাদের রাজা মশাই ছিলেন একজন সত্যিকারের পরিহাস-প্রিয় আমুদে মানুষ। তার মতো পরিহাস-প্রিয় মানুষ আর কেউ দেখে থাকলেও আমার চোখে অন্তত দ্বিতীয় কেউ পড়েনি।
রাজা মশাইয়ের হাস্যরসসিক্ত কথাবার্তা শুনলে আমার মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা জন্মত, তিনি বুঝি পরিহাসের জন্যই পৃথিবীতে জীবনধারণ করছেন।
আমি বহুবারই লক্ষ্য করেছি তার কাছে যথার্থ রসসিক্ত একটা গল্প বেশ রস দিয়ে দিয়ে পরিবেশন করতে পারলেই তার অনুগ্রহ লাভ নিশ্চিত হয়ে উঠত। তাই তো রাজা মশাইয়ের রাজসভার নয় জন মন্ত্রিই ছিলেন সত্যিকারের রসিক প্রবর। তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই রসবোধ খুব টনটনে ছিল। আর এ রসবোধের জন্য রাজ্যে তাদের খ্যাতিও ছিল যথেষ্টই।
বিশাল বপুর অধিকারী রাজা মশাইয়ের মতোই মন্ত্রিরাও ছিলেন বিশালদেহী। যাকে বলে প্রত্যেকেই রীতিমত স্থূলদেহী। গা দিয়ে যেন তেল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। আর অনুকরণযোগ্য হাস্যরস তো সবার মধ্যে ছিলই।
আমার অবশ্য এরকম কোনো তথ্য জানা নেই যে, হাস্যরসের অধিকারী অর্থাৎ যথার্থ রসবোধ থাকলে কেউ সুবিশাল বপুর অধিকারী হন কি না, অথবা স্থূলদেহের মধ্যে এমন বিশেষ কিছুর উপস্থিতি থাকে কি না যা তার মধ্যে রসবোধের সঞ্চার ঘটায়, তাকে পরিহাসপ্রবণ করে তোলে কি না।
তবে আমার স্বল্প অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যে ধারণা লাভ করতে পেরেছি, তা হচ্ছে–হাস্যরসিক অথচ ক্ষীণদেহী কোনো ব্যক্তি বিরলই বটে।
রাজা মশাই অন্য কোনোরকমে কলাকুশলতা, তার ভাষায় জ্ঞানবুদ্ধির ঢেকী– দের নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতে নারাজ। অর্থাৎ বুদ্ধির মাপকাঠি দিয়ে তিনি কোনো ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্বের বিচার করতে তিলমাত্র উৎসাহিও নন।
হাস্যরস, রঙ্গ-রসিকতা তার প্রজাদের মধ্যে বিস্তার লাভ করুক এটাই তার আন্তরিক অভিপ্রায়। আর যারা আচার ব্যবহার আর কথাবার্তার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে রসবোধের বীজ ছড়াতে ব্রতী, তাদের তিনি পঞ্চমুখে প্রশংসা তো করেনই এমনকি অনুগ্রহ দানেও ধন্য করে থাকেন। শুধু কি এ-ই? তার জন্য প্রয়োজন হলে তিনি তার বিস্তারকেও হাসিমুখে বরদাস্ত করেন। তবে এও খুবই সত্য যে, সূক্ষ্ম রসিকতাকে তিনি কেবলমাত্র যে অবজ্ঞা করতেন তা-ই নয়, যারপরনাই ক্লান্তি বোধ করেন। তখন কেমন যেন একটা অবর্ণনীয় বিতৃষ্ণায় তার মন-প্রাণ ভরে উঠত।
আর বিখ্যাত লেখক র্যাবেশ-এর গর্গান্টুয়া নামক বইটার কথাশিল্পী ভলতেয়ার এর লেখা জাদিগ বইটার তুলনাই তার কাছে অনেক, অনেক বেশি প্রিয়। মোদ্দা কথা, মৌলিক কোনো পরিহাসের তুলনায় বাস্তব পরিহাস তার কাছে বেশি আকর্ষণীয়। আর তা বেশিমাত্রায় রুচিকর বলেও বিবেচিত হয়।
আমি এখন যে কাহিনীর অবতারণা করতে চলেছি, তখন রাজসভা থেকে বিদুষক-বৃত্তিটা পুরোপুরি লোপ পায়নি। বরং তারা স্বয়ং রাজা মশাই ও সভাসদদের দ্বারা যথেষ্ট সমাদৃতই হতেন।
সত্যি কথা বলতে কি, তিনি বিশাল মহাদেশের রাজ-রাজড়া বিদূষকদের যথেষ্ট সমাদরের সঙ্গেই নিজ নিজ রাজদরবারে স্থান দিতেন। আরও সংক্ষেপে বলতে গেলে, উপযুক্ত বেতনদানের মাধ্যমে তাদের পুষতেন।
বিদুষকরা হরেক রঙের পোশাক গায়ে চড়িয়ে আর ঘণ্টাসহ বিচিত্র ধরনের টুপি মাথায় চাপিয়ে রীতিমত হাসির উদ্রেককারী সাজেনিজেদের সাজিয়ে তুলত। আর তারা প্রত্যেকেই ছিল এক-একটি চলমান হাসির যন্ত্র। সোজা কথা, তারা ছিল স্বভাবরসিকপ্রবর। হাসির কথা আর গল্প থাকত তাদের জিভের ডগায়। যে কোনো সময়, যে কোনো পরিবেশে মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলাই ছিল তাদের একমাত্র কর্তব্য। আর বিনিময়ে তাদের বরাতে জুটত রাজার টুকরো টুকরো অনুগ্রহ। রাজা খুশি হয়ে যেটুকু অনুগ্রহ দাক্ষিণ্য তার দিকে ছুঁড়ে দিত, তা মাথা পেতে নিয়েই তারা সন্তুষ্ট থাকত।
আমাদের মতো রাজা মশাইও একজন সত্যিকারের হাস্যরসিক। মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, সাতজন মন্ত্রীর মতো সাতজন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির–রাজা মশাইয়ের নিজের কথা না হয় ছাড়ান দেওয়াই হলো এরও দরকার অবশ্যই ছিল। আসলে এ জ্ঞান গুণের বোঝার ভারসাম্য অব্যাহত রাখার জন্যও তো একজন বোকাসোকা লোকের উপস্থিতি চাইই চাই।
রাজা মশাইয়ের বেতনভুক হাস্যরসিকটি, মানে বিদুষক বলে সমধিক খ্যাত। সে অবশ্যই কেবলমাত্র একজন বিদুষকই ছিল না। রাজা মশাই তাকে তার বিদুষক হিসেবে প্রাপ্য সমাদরের তিন গুণ সমাদর দিয়েছিল। কারণ কি? কারণ তো অবশ্যই ছিল। বিদুষকের গুণাবলীর ধারক ছাড়াও সে ছিল একজন বামন আর পঙ্গু।