এদিকে নদীর পানি ফুলে-ফেঁপে বন্যার রূপ ধারণ করে তীব্র বেগে ধেয়ে আসতে লাগল। পানির উপরিভাগে এমন ফেণার আস্তরণ তৈরি হল, যা দেখে মনে হলো নদীর বুকে যেন পানি নয়, সফেন কোনো দৈত্য ছড়িয়ে দিয়েছে। আর মাটি কামড়ে ধরে জলপদ্মগুলো অনবরত আর্তনাদ করে চলেছে। একটু আগেও আর সদম্ভে মাথা উঁচিয়ে যেসব গাছ দাঁড়িয়ে ছিল, এখন ঝড়ের দাপটে সেগুলোই বার বার অসহায়ভাবে মাথা নোয়াচ্ছে।
আরও আছে, আকাশের একপ্রান্ত থেকে বুক চিড়তে চিড়তে দ্রুততম গতিতে অগ্রসর হয়ে বজ্র আকাশের অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। আর সে সঙ্গে মুহূর্তের জন্য হলেও আকাশের একটা বড় ভগ্নাংশকে উজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত করে দিচ্ছে। বজ্রের প্রচণ্ড শব্দে পাহাড়ের মূল পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে উঠছে।
আমি কাছ থেকে, গোপন অন্তরাল থেকে বিচিত্ৰদৰ্শন লোকটার কাণ্ডকারখানার ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে লাগলাম। আমি লক্ষ করলাম অখণ্ড অন্তহীন নৈঃশব্দ তার মধ্যে বার বার কম্পন সৃষ্টি করছে–সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠছে। রাত অনবরত বেড়েই চলেছে।
আমি আর নিজেকে সামলে সুমলে রাখা সম্ভব হলো না। আমি ক্রোধ সম্বরণ করতে না পেরে নদী, আকাশ, অতিকায় জলপদ্ম, অরণ্য, বাতাস আর বজ্রকে অভিশাপ দিলাম প্রাণভরে। আর অভিশাপে জর্জরিত করলাম জলপদ্মগুলোর দীর্ঘশ্বাসকে।
আমার অভিশাপকে সহ্য করতে না পেরে তারা সবাই নিশ্চল,নিথর আর অনড় হয়ে পড়ল।
আমার অভিশাপে বজ্রের অপমৃত্যু হল, চাঁদের গতিরুদ্ধ হওয়ায় স্তব্ধ হয়ে পড়ল, অত্যুজ্জ্বল আলোকচ্ছটার আধার বিদ্যুৎ আর চমকাল না। কয়েকমুহূর্ত আগেও যে ঘনকালো মেঘের টুকরোগুলো গতিশীল ছিল এখন সেগুলোই নিশ্চল অবস্থায় আকাশের গায়ে ঝুলছে, ফুলে-ফেঁপে ওঠা নদীর পানি ক্রমে নামতে নামতে তলদেশ স্পর্শ করেছে, সেখানেই রয়ে গেছে আর জলরাশি গতি হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে, পদ্মবন থেকে বিচিত্র গুনগুনানি অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে, আকাশ ছোঁয়া গাছগুলোর অস্থিরতা বন্ধ হয়ে গেছে, জলপদ্মগুলো দীর্ঘশ্বাস ছাড়া বন্ধ করে দিয়েছে, বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত মরুভূমির কোনো জায়গা থেকেই এতটুকুও শব্দ উত্থিত হচ্ছে না–একেবারেই শুনশান অবস্থা।
আমার চোখ দুটো চারদিকে চক্কর মারতে মারতে এক সময় বিশালায়তন পাথরটার গায়ে স্থির নিবদ্ধ হয়ে গেল। তার গায়ে উল্কীর্ণ করে রাখা লেখাটার গায়ে এবার নতুন করে চোখের মণি দুটোকে বার-বার বুলাতে লাগলাম। এখন দেখলাম, সেখানে নৈঃশব্দ শব্দটা লেখা রয়েছে। স্পষ্টাক্ষরে শব্দটা খোদাই করা।
পাথরটার গা থেকে দৃষ্টি তুলে নিয়ে আমি আবার বিচিত্র কায়দায় বসে-থাকা মানুষটার দিকে নিবদ্ধ করলাম।
তার মুখাবয়টার আকস্মিক পরিবর্তনটুকু আমার নজর এড়াল না। সে মুখটা এমন নিঃসীম আতঙ্কে ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গেছে।
সে মানুষটা যন্ত্রচালিতের মতো ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। উল্কর্ণ হয়ে শব্দ শোনার চেষ্টা করল সত্যি। কিন্তু মরু অঞ্চলের কোনো প্রান্তেরই গা-বেয়ে উঠে এলো না কোনো শব্দ–কোনো কণ্ঠস্বর।
পাথরটার গায়ে যে নৈঃশব্দ কথাটা লেখা রয়েছে, সে স্থানটাকে আরও অনেক, অনেক বেশিনিস্তব্ধ বলে মনে হলো।
লোকটা অনবরত থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে পাথরের শীর্ষদেশের আসনটা ছেড়ে নেমে এলো।
ব্যস, চোখের পলকে সে বেপাত্তা হয়ে গেল। তারপর মুহূর্তের জন্যও আমি আর তাকে দেখতে পাইনি।
বামন দৈত্যটা গল্পটা শেষ করে নীরব হলো।
সত্যি বলছি, আমি বহুদেশে, বহু লোকের মুখে অনেক উদ্ভট গল্প শুনেছি, দেশ বিদেশের বহু গল্প পড়েছিও বটে। কিন্তু এমন আর একটা কাহিনী কারো মুখেই শুনিনি, ভবিষ্যতেও শুনতে পাব বলে মনে হয় না।
সেই বেলুনের কাহিনী
আকাশচারী স্যার জর্জ ক্যালি আর মি. হেসনের দু-দুটো সাম্প্রতিক ব্যর্থতার জন্য আকাশপথে সমুদ্র পাড়ি দেবার ব্যাপারটায় সাধারণ মানুষের উৎসাহ-আগ্রহে যথেষ্ট পরিমাণে ভাটা পড়েছে।
কেবলমাত্র সাধারণ মানুষই নয়, বৈজ্ঞানিকরাও মি. হেনসনের আকাশপথে ভ্রমণের পরিকল্পনাটাকে গোড়ার দিকে খুবই কার্যকরী বলে ভেবে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বিচার করে দেখা গেল, মি. হেসনের পরিকল্পনাটার গোড়ায় গলদ রয়ে গিয়েছিল। পরে স্যার জর্জ ক্যালি পরিকল্পনাটার গলদটুকু ঝেড়ে মুছে ফেলে দিয়ে গলদটুকু শুধরে দিয়ে বেলুন-যন্ত্রটার খোলটাকে পালটে নিলেন। আর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশনের মডেল পরীক্ষাও করলেন। কিন্তু হায়! এতকিছু করার পরও তিনি পরিকল্পনামাফিক বেলুনটাকে আকাশে ওড়াতে পারলেন না। দারুণভাবে ব্যর্থ হলেন তিনি।
শেষপর্যন্ত যা ঘটল, স্যার জর্জ কেলির পরিকল্পনাটা পুরোপুরি মাঠে মারা গেল।
উপরোক্ত ঘটনারাই ঠিক সমসাময়িককালেই মি. মংক ম্যাসন বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানি আর্কিমিডিসের সূত্র অবলম্বনের মাধ্যমে একটা বেলুন তৈরি করে সেটাকে উইলিসের কক্ষেনির্ববাদে চালিয়ে দেখালেন। সার্থক প্রয়াস। তারপর তিনি এডিলেড গ্যালারি তে মডেলটাকে নিয়ে গেলেন।
প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, স্যার জর্জ কেলি ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে যখন নাসাউ নামক বেলুনে চেপে ডোভার থেকে উইলবার্গে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন। চারদিকে রীতিমত হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। তুমুল হৈচৈ শুরু হবার মতো ব্যাপার তো অবশ্যই। বেলুনে চেপে ডোভার থেকে একেবারে উইলবার্গ–কম কথা!