কদর্য আর অতিকায় পাথরটার সামনের দিকে কি সব কথা উত্তীর্ণ করে রাখা হয়েছে।
পাথরটার দিকে চোখ পড়তেই আমার মধ্যে কৌতূহল দানা বাঁধল। সে কৌতূহল ক্রমে ঘনীভূত হয়ে ওঠায় আমি ভেতরে ভেতরে বড়ই অস্থির হয়ে পড়লাম।
নিদারুণ অস্থিরতার শিকার হয়ে আমি গুটিগুটি অতিকায় পাথরটার দিকে এগিয়ে গেলাম বৃষ্টি অনবরত ঝরেই চলেছে। জলপদ্মের ঝোঁপ ঠেলে-ধাকে এগোতে এগোতে আমি গিয়ে পাথরটার সামনে, একেবারে গা-ঘেঁষে দাঁড়ালাম।
পাথরটার গায়ে উত্তীর্ণ অক্ষরগুলো যাতে আমি ভালোভাবে দেখতে পাই, পড়তে পারি, সে জন্যই এত কাছে যাওয়া।
পাথরটার একেবারে কাছে এগিয়ে গিয়েও আমাকে হতাশ হতে হলো। ওগুলো যে আসলে আদৌ কোনো ভাষারই অক্ষর নয়–সাঙ্কেতিক চিহ্ন। ফলে আমার পক্ষে কিছুই পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হলো না। হতাশায় বুকটা ভরে গেল। ফুসফুস নিঙড়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
অনন্যোপায় হয়ে জলপদ্মের ঝোঁপের দিকেই বিষণ্ণ মনে ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছিলাম।
পিছন ফিরে একটা পা বাড়াতে না বাড়াতেই আচমকা চাঁদের আলো যেন খুব বেশি রকম বেড়ে গেল। ঝলমলে আলো আমার ঠিক মাথায় এসে ঝরে পড়ল।
ক্রমে চাঁদের আলো যেন আরও অনেক, অনেক বেশি রক্তিম হয়ে উঠল। আমি ঝট করে পিছন ফিরে আবার সুবিশাল পাথরটার দিকে তাকালাম। তার গায়ের উত্তীর্ণ লেখাটা এবার আরও স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠল। একটাই শব্দ।
হঠাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে পাথরটার ওপরের দিকে তাকালাম। দেখলাম, পাথরটার মাথায় একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। দীর্ঘদেহী।
আমি ঝট করে পদ্মবনে গা-ঢাকা দিয়ে দিলাম। লোকটা যাতে আমাকে দেখতে পায়, সেজন্য সাধ্যমত নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ঘাপটি মেরে রইলাম। দৃষ্টি কিন্তু সে লোকটার ছায়া ছায়া মূর্তিটার দিকেই নিবদ্ধ রাখলাম।
আগেই বলেছি, লোকটা দীর্ঘদেহী, রাজকীয় চেহারা আর রোমক পোশাক পরিচ্ছদে কাঁধ পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। অন্ধকারে তার মুখটা পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যায়নি। কুয়াশা, ছিটে ছিটে শিশিরের মতো বৃষ্টিতেও তার মুখটাকে দেখা যাচ্ছে। তার কপালটা কুঞ্চিত আর কুটিল দুচোখে উদ্বেগের সুস্পষ্ট ছাপ বর্তমান আর গাল দুটোতে
অগণিত গভীর রেখা যাদের তলায় কবরস্থ রয়েছে যেন বহু চাপা দুঃখ-যন্ত্রণা।
লোকটা এবার পাথরটার শীর্ষে পা গুটিয়ে অদ্ভুত কায়দায় বসে পড়ল। তারপরই নিস্পলক চোখে রক্তিম জ্যোৎস্নালোকিত বিস্তীর্ণ জনহীন প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে প্রকট হয়ে উঠেছে মানবজাতির প্রতি প্রগাঢ় বিতৃষ্ণা। আর লক্ষিত হচ্ছে অসীম ক্লান্তি অবসাদ আর নির্জনতার সন্ধানের প্রয়াস।
সে হাঁটুর ওপর ভাজ করে রাখা হাতের ওপর চিবুক রেখে অশান্ত জলপদ্মের বনের ওপর অস্থির চোখের মণি দুটোকে বার কয়েক বুলিয়ে নিল। পরমুহূর্তেই দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকাল আকাশছোঁয়া গাছগুলোর মাথার দিকে, কালো মেঘের টুকরোগুলো কালো বুনো ঘোড়ার মতো হারা উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে। সবশেষে দৃষ্টি ফিরিয়ে সে তাকাল রক্তিম চাঁদটার দিকে।
হঠাৎ একেবারে হঠাৎ-ই লোকটার সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি পদ্মবনে নিজেকে লুকিয়ে রেখেই তার আকস্মিক সৃষ্ট কাঁপুনি প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। আমি স্পষ্টই লক্ষ করলাম, অস্বাভাবিক কেঁপেই চলেছে তার আপাদমস্তক।
কেন এ কাঁপুনি? নিঃসীমনিস্তব্ধতাই তার কাঁপুনির মূল কারণ।
সে কিন্তু মুহূর্তের জন্যও বিচলিত হয়ে স্থানত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেল না। বরং একইভাবেই, একই ভঙ্গিতে বিরামহীনভাবে সে বসেই রইল।
আকাশের গায়ে ঝুলে থাকা রক্তিম চাঁদটার গা থেকে চোখ দুটোকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে সে এবার নিরানন্দ জেইরী নদীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। চোখের সামনে ভেসে উঠল হলদেটে কুদর্শন জলস্রোত। গা ঘিন ঘিন করে, বার বার কাঁটা দিয়ে ওঠে। এবার তাকাল দুপাড়ের মড়ার মতো ফ্যাকাশে রঙে প্রান্তরের দিকে।
সে এবার উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগল। হতাশায় জর্জরিত জলপদ্মগুলোর নিরবচ্ছিন্ন দীর্ঘশ্বাস–যার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন গুনগুন মিলেমিশে একাকার হয়ে রয়েছে যাকে জেইরী নন্দীর খরস্রোত থেকেই উদ্ভুত বলেই মনে করা হচ্ছে।
আমি কাছ থেকে, খুবই কাছ থেকে তার নৈঃশব্দের নিরবচ্ছিন্ন অস্বাভাবিক কম্পন। চাক্ষুষ করলাম। রাত ক্রমে বেড়েই বেড়েই চলল। সে পাথর ওপরে একই ভঙ্গিতে ঠায় বসেই রইল। আর আমি? আমি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে তার প্রতিটা মুহূর্তের গতিবিধির ওপর নজর রেখে চললাম। মুহূর্তের জন্যও আমি তার ওপর থেকে দৃষ্টি ফেরাইনি, ফেরাতেই পারিনি।
ঠিক সে মুহূর্তে আমার মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক ভাবান্তর ঘটে গেল। আমি ঠিক তখন অভিশাপ দিয়ে উঠলাম।
ভৌতবস্তুদের উদ্দেশ্যে দেওয়া আমার সে অভিশাপ দূর আকাশের গায়ে তুমুল ঝড় দেখা দিল। কী সে প্রলঙ্কর বিধ্বংসী সে ঝড়, তা আর বলার মতো নয়। আমার মনে হলো বুক-কাঁপানো সে-ঝড়ের তাণ্ডবে সৃষ্টি বুঝি ধ্বংস হয়ে যাবে।
সত্যি অবাক হবার মতো ব্যাপারই বটে। একটা আগেই যেখানে হাওয়া বাতাসের লেশমাত্রও ছিল না, সেখানে এমন তুমুল ঝড় যে বাস্তবিকই কল্পনাতীত ব্যাপার। এটা অবশ্যই আমার সে জ্বলন্ত অভিশাপেরই ফল।
মুহূর্তের মধ্যেই বৃষ্টির বেগ আগের তুলনায় যেন হাজারগুণ বেড়ে গেল। আর বৃষ্টির জলধারা পাথরটার ওপর বসে থাকা লোকটার মাথায় অনবরত ঝমঝম করে। পড়তে লাগল।