ছায়া মূর্তিটা আগের মতোই নিরুত্তাপভাবে ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়েই রইল। টু-শব্দটিও করল না।
আমি আগের মতোই গম্ভীর স্বরে বললাম–তোমাকে দেখামাত্র আমার মধ্যে এমন বিশেষ প্রভাব জাগল কেন? আর এমন নিরবচ্ছিন্ন আতঙ্কের সঞ্চার ঘটছে কেন, কিছুই বুঝতে পারছি না। তাই ছায়াটা ক্ষীণকণ্ঠে উচ্চারণ করল–আমি ছায়া।
সে তো বুঝতেই পারছি, তুমি ছায়া ছাড়া কিছুই নও।
তবে আর কি জানতে চাইছ?
আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটার জবাব–কোথায় থাকো তুমি?
খালের নিকটবর্তী প্রান্তরে–পাতাল-সমাধির নিকটে।
অস্বীকার করব না, তার কণ্ঠস্বর কানে যেতেই আমরা সাতজনই আতঙ্কে রীতিমত শিউরে উঠলাম। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কারণ, সে কণ্ঠস্বর অবশ্যই একজনের নয়, বহুকণ্ঠের মিলিত স্বর। ওই একটামাত্র স্বরের মধ্যে বহু সত্না যেন মিলেমিশে একাকার। তারা একই সঙ্গে কথা বলল।
আর ওই একটামাত্র স্বরের মধ্যেই আমাদের হাজার হাজার মৃত বন্ধুর পরিচিত কণ্ঠস্বর ছায়ামূর্তিটির কণ্ঠ দিয়ে উচ্চারিত হলো। সবাই সমস্বরেই কথা বলে উঠল।
সাইলেন্স-এ ফেল
বামন দৈত্য!
বামন-দৈত্যটা আমার সামনে, একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।
আমি আকস্মিক ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই বামন-দৈত্যটা মুখ খুলল–এই যে, আমি কি বলছি, ধৈর্য ধরে শোনো, তোমাকে আমি এখন যে অঞ্চলের কাহিনী শোনাব, তা নিরানন্দ, সে-ছোট্ট জায়গাটা লিবিয়ায় অবস্থিত। জেইরি নদীর তীরে সেটাকে দেখতে পাবে। সেখানে প্রশান্তি বিরাজ করছে না, আবার নৈঃশব্দও কিন্তু না।
ওই যে জেইরি নদীর কথা বললাম, তার রঙ গেরুয়া রঙের হলেও, কদর্য না বলে পারা যায় না। সমুদ্রের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য ছুটে যায় না। লাল সূর্যের তলা দিয়ে কুলকুল রবে প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছে তো চলেছেই। মুহূর্তের জন্যও তার এ চলার বিরতি নেই।
আর নদীটার গতিবেগ? তীব্র। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে, নদীটা যেন খিচুনি ব্যানোর শিকার হয়ে প্রতিটা মুহূর্তনিদারুণ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছে।
নদীটার দুইকূল বরাবর মাইল দুই পর্যন্ত ধূসর মরুভূমির বুকে পাঁপড়ি মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে অতিকায় জলপদ্ম। জলপদ্মের দল তারা গভীর নৈঃশব্দে অনবরত দীর্ঘশ্বাস ফেলে একে অন্যের দিকে টুলটুল করে তাকিয়ে থাকে আর আকাশের দিকে অস্বাভাবিক লম্বা ঘাড় উঁচিয়ে বার বার মাথা দোলাতে থাকে।
ওই পদ্মবনের দিক থেকে অনবরত যে গুনগুন রব ভেসে আসে, তা শুনে মনে হয়, ওই খরস্রোতা নদীর বুক থেকেই বুঝি নির্গত হয়ে বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে এসে কানে বাজছে। তবু তারা একে অন্যের দিকে ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাহাকার করে। প্রতিটা বুক বুঝি অব্যক্ত ব্যথা-বেদনায় ফেটে যাচ্ছে। আর এরই ফলে তারা অনাদি-অনন্তকাল ধরে এভাবে বাতাসে দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে চলেছে।
এ অত্যাশ্চর্য অঞ্চলটার কিন্তু একটা সীমারেখা রয়েছে। যে সীমারেখা সৃষ্টি হয়েছে গভীর ছায়াছায়া আকাশচুম্বী বনাঞ্চল দিয়ে। যদিও সেখানকার স্বর্গ থেকে মর্ত্য অবধি কোথাও বাতাসের লেশমাত্রও নেই, তবু যেন আকাশচুম্বি গাছগুলোর তলার দিককার ডালপালা প্রতিনিয়ত বাতাসে দোল খাচ্ছে। যেন হাত-পা ছড়িয়ে নাচানাচি করছে।
অতিকায় গাছগাছালি উত্তর-পশ্চিম আর দক্ষিণ-পূর্ব দিক লক্ষ করে বার বার দুলে দুলে উঠছে। তাদের ডালে-ডালে, পাতায়-পাতায় ঘর্ষণের শব্দ যেন কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে।
প্রাগৈতিহাসিক বনাঞ্চল বলেই না এরা এরকম রোমহর্ষক শব্দ সৃষ্টি করতে সক্ষম।
আরও আছে, প্রতিটা গাছের মাথা থেকে টপটপ করে শিশিরবিন্দু প্রতি মুহূর্তে ঝরে পড়ছে। শিশির পড়ার বিরতি নেই, শেষ নেই আর শিশির জমার শেষ নেই।
অতিকায় গাছগুলোর শিকড় জুড়ে অদ্ভুত বিষাক্ত ফুলের গোছা যেন অত্যাশ্চর্যভাবে দোল খাচ্ছে, নাচানাচি, দাপাদাপি করছে। তারা চিরনিদ্রার কোলে ডুবে থাকলেও সর্বদা সঞ্চারমান, কারণ? কারণ তো অবশ্যই আছে। কারণ রাত-দিন তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে। সুখন্দ্রিা বলতে যা বোঝায় তা আদৌ তাদের অদৃষ্টে নেই।
তাদের মাথার ওপর দিয়ে টুকরো টুকরো কালো মেঘের দল বাতাসে দোল খেতে খেতে ছুটে চলেছে।
মেঘের দল অনবরত পশ্চিমে ছুটতে ছুটতে শেষমেশ একসময় চক্কর খেয়ে খেয়ে জলপ্রপাত সৃষ্টি করছে–দূর দিগন্তের ওপারে দুঃসপ্নময় এক অজানা-অচেনা রাজ্যে। অথচ আকাশের কোথাও এক তিল বাতাসের অস্তিত্বও নেই।
জেইরী নদীর দুকূলেও এতটুকু প্রশান্তি নেই, নেই নৈঃশব্দের নাম গন্ধও। এ যেন দুঃস্বপ্নময় এক অবিশ্বাস্য রাজ্য।
ও তের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। যখন পড়ে তখন তো বৃষ্টি হয়েই পড়ে, কিন্তু পর মুহূর্তেই তা লালবর্ণ ধারণ করছে, রক্ত বিন্দুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
লম্বা ও লম্বা-পাতাবিশিষ্ট পদ্মবনে দাঁড়িয়ে আমি বৃষ্টিতে ভিজছিলাম, আমার সর্বাঙ্গে ঝরঝর করে পানি অনবরত ঝরছিল। আর জলপদ্মগুলো নির্জন-নিরালা। পরিবেশে একে অন্যের দিকে ফিরে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল।
অসহ্য জমাটবাধা কদাকার কুয়াশার চাদর ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে আকাশের চাঁদ উঁকি দিল। রূপালি নয়, রক্তের মতো টকটকে লাল চাঁদ। নদীর তীরে অবহেলিতভাবে পড়ে থাকা একটা অতিকায় পাথরের দিকে আমার চোখ পড়ল। ধূসর রঙের পাথরটার গায়ে চাঁদের আলো পড়ায় সেটা অদ্ভুত এক রঙ ধারণ করেছে।