আমি এও স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, ছায়ামূর্তিটার কণ্ঠস্বর কোনো একজন মানুষ বা অন্য কোনো জীবের কণ্ঠস্বর অবশ্যই নয়। অসংখ্য মানুষ যেন সমস্বরে, বিচিত্র সুরে কথাগুলো বলল। হাজার হাজার পরলোকগত বন্ধু যেন তাদের বিস্মৃত কণ্ঠস্বরে কথাগুলো আওড়ে গেল।
শ্যাডো-এ প্যারেবল
আপনি তো আজও বেঁচে রয়েছেন।
আপনার দেহে এখনও প্রাণের অস্তিত্ব আছে বলেই তো এ কাহিনী পড়তে পারছেন। আর আমি? আমি কিন্তু অনেক আগেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে ছায়ালোকের বাসিন্দা হয়ে গেছি। এখন সে লোকেরই স্থায়ী বাসিন্দা আমি।
আমার স্মৃতিকথা সম্বলিত নোট বইটার পাতায় যখন মানুষ চোখ বুলাবে, তার আগেই বহু অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে যাবে। বহু সংখ্যক গোপন রহস্যের কথা জানা যাবে। আর বহু শতাব্দীও পেরিয়ে যাবে।
আমার এ নোট বইটার পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে কিছু মানুষ বিশ্বাস করতে এতটুকুও উৎসাহি হবে না, এমনকি অনেকে অন্তরে সন্দেহ পোষণ করবে, প্রকাশও করবে কেউ কেউ। তবুও আমার এটুকু বিশ্বাস অন্তত আছে যে, আমার এ কলমের ডগা দিয়ে যে সব চরিত্রকে তুলে ধরেছি, তাদের নিয়ে বেশ কিছু লোক অবশ্য চিন্তা ভাবনা করবেই করবে।
যে বছরটার কথা আমি নোট বইটার পাতায় তুলে ধরেছি, সে বছরটা ছিল যথার্থই এক আতঙ্কের বছর। তবে আতঙ্কের চেয়ে ছিল উপলব্ধির ব্যাপার।
কীসের উপলব্ধি? কেমনতর উপলব্ধি? আজও পৃথিবীতে যে উপলব্ধির নামকরণ করা সম্ভব হয়নি। বহু অদ্ভুত ব্যাপার আর কুলক্ষণের পরে জল আর স্থল উভয় পরিবেশের ওপর দিয়ে মহামারীর ভয়ঙ্করতা ছড়িয়ে পড়েছিল। সমুদ্র-উপকূলবর্তী দেশগুলোতেও দ্রুত মহামারীর কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়েছিল।
জ্যোর্তিবিজ্ঞান সম্বন্ধে যারা ঝানু তারা নিশ্চয়ই জানতেন, অশুভ ইঙ্গিতে মহাকাশ পরিপূর্ণ। কেবলমাত্র আকাশ-মহাকাশের চেহারাই সে অদ্ভুত হয়ে উঠেছিল তা কিন্তু নয়, মানুষ জাতটার জ্ঞান-বুদ্ধি, বিজার-বিবেচনাবোধই অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল।
আমরা সাতজন তখন টলোমেস নামক ছোট্ট ও নিষ্প্রাণ শহরে ঢুকে একটা সুসজ্জিত হলো ঘরে বসেছিলাম।
রাত বাড়তে বাড়তে ক্রমে গম্ভীর হয়ে এলো।
ইতিমধ্যেই কয়েক বোতল গাঢ় ঘন চীনা মদ পেটে চালান হয়ে গেছে।
এ ঘরে ঢোকার একটা পথ। একটা মাত্র দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকা ও বেরনো যায়। তবে দরজাটা একটু বিশালই বটে। আর পাল্লা দুটো তামা দিয়ে তৈরি। তার গায়ে চমৎকার নকসা করা। একবার তাকালেই সেটা থেকে চোখ ফেরানো দায়।
দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া। গাঢ় কালো রঙের পর্দা ঝুলছে। তবে অন্ধকার ঘরের সঙ্গে সেটা খুবই মানানসই হয়েছে।
আকাশে গাছে ছোট-বড় হরেক আকৃতির নক্ষত্র ঝুলছে। তবে সেগুলো খুবই ফ্যাকাশে, মড়ার মতো। চাঁদের হালও একই রকম। আর জনহীন পথ নজরে পড়ছে না। তবে এও সত্য যে, কালো পর্দার জন্য এরা নজরে না পড়লেও ঘরের সর্বত্র যে অশুভ আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না–পরিষ্কার বুতে পাচ্ছি।
আমার চারদিকে এমনকিছু অবস্থান করছে যাদের সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর সে সব জিনিস যে বস্তুময় এতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। আবার এও খুবই সত্য সে সব প্রেতময়ও বটে।
বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। আর তা এতই ভারী যে, যেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসার যোগার হয়েছে, অবর্ণনীয় উদ্বেগ বুকে যেন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। ভয়ঙ্কর সে সত্ত্বার কয়াল অস্তিত্ব সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে।
তার উপস্থিতি, তার অস্তিত্ব বুঝতে পারা যায় ঠিকই। কিন্তু কখন আর কিভাবে? অনুভূতি যদি তীব্র আর জাগ্রত থাকে। তখন চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে যায় প্রাণের অস্তিত্বহীন গুরুভার যেন ঠিক শিয়রে অবস্থান করছে। আর প্রতিটা মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গও সে শূন্যে অবস্থানরত গুরুভারের উপস্থিতিতে ক্রমেই অবশ হয়ে পড়তে যাচ্ছে।
আমরা সাতজনই থমকে গেছি। ঘরের প্রতিটা আসবাব্যন্ত্রের ওপরেও অসহনীয় গুরুভার চেপে বসতে চাইছে। এমনকি মদের বোতলগুলোও সে গুরুভারের কবল থেকে বোধহয় অব্যাহতি পাবে না। শূন্যস্থিত গুরুভাব তাদের ওপরেও অসহনীয় গুরুভাবে চেপে বসতে চাইছে। আমরা সাতজন হ্যাঁ, সাতজনই অস্বাভাবিক মিইয়ে পড়েছি। কেবলমাত্র আমাদের কথাই বা বলি কেন? ঘরের ভেতরে যা কিছু রয়েছে। সবই যেন অস্বাভাবিক কমে গেছে। সাতটা লোহার তৈরি প্রদীপ ছাড়া, তারা সাত সাতটা আগুনের শিখা জ্বালিয়ে রেখে আমাদের একেবারে নিভে যেতে দিচ্ছে না।
লোহার তৈরি সাতটা প্রদীপের শিখানিষ্কম্পভাবে জ্বলে ফ্যাকাশে বর্ণের আলোক বিতরণ করেই চলেছে। ঘরের সবকিছুর এমন গুমোট পরিস্থিতিকে তিলমাত্র পারোয়াও করে না।
আবলুস কাঠের মসৃণ গোল টেবিলকে ঘিরে আমরা সাতজন কাছাকাছি, একেবারেই পাশাপাশি বসে রয়েছি।
টেবিলগুলো এতই মসৃণ এবং চকচকে যে, সাত-সাতটা আলোক শিখা তার গায়ে আছড়ে পড়েই প্রতিফলিত হচ্ছে, ঘরময় ছড়িয়ে পড়ছে অত্যুজ্জ্বল আলোকের রশ্মি।
আমরা সাতজনই মসৃণ আবলুস কাঠের গোল টেবিলে মাথানিচু করে বসে রয়েছি বলে প্রত্যেকেই একে অন্যের নিজের এবং একে অন্যের ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখ দেখতে পাচ্ছি। এমনকি সঙ্গী সাথিদের অস্থির চোখের মণি দুটোও নজরে পড়ছিল।