আমি ওইনস বুঝতে পেরেছিলাম, খুবই সত্য বটে, মৃতের চোখ দুটো আমার দিকে স্থির নিবদ্ধ, তা সত্ত্বেও আমি না বোঝার ভান করলাম, অর্থাৎ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে বুঝেও কিছুই বুঝিনি এমন ভাব দেখাতে লাগলাম। আসলে আমি বুঝতেই চাইলাম না, বরং সামনের আবলুস কাঠের আয়নার গভীরে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলাম। পর মুহূর্তেই গম্ভীর গলায় তার স্বরে গাইতে আরম্ভ করলাম। কোন গান–কোন গানের সুর? টিয়স-পুত্রের গানগুলো।
না, বেশিক্ষণ গান গাওয়া সম্ভব হলো না। কয়েকটা পংক্তি গাইতে না গাইতেই আমার গলা ক্রমে নেমে যেতে আরম্ভ করল। তারপর এক সময় গান না থামিয়ে পারলাম না।
গান থামিয়ে দিলেই কি গানের রেশটুকু পুরোপুরি মিলিয়ে গেল? না, অবশ্যই তা নয়। আমার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি ঘরের লোমশ পর্দার গায়ে বাধা পেয়ে, পর্দার ওপর চক্কর খেতে খেতে ক্রমে ক্ষীণ ও অস্পষ্ট হতে হতে দূরে, বহু দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়ে সম্পূর্ণরূপে মিলিয়ে গেল।
ব্যস। আবার একেবারে শুনশান, ঘরে যেন কবরখানার নীরবতা নেমে এলো।
আরে ব্যস! এ কী! এ কী অবিশ্বাস্য কাণ্ডরে বাবা! যে লোমশ পর্দাটার গায়ে বাধা পেয়ে আমার কণ্ঠস্বর সম্পূর্ণরূপে মিলিয়ে গেল, সেখান থেকে একেবারে অবিশ্বাস্য উপায়ে একটা ছায়ামূর্তির আর্বিভাব ঘটল। তবে ছায়ামূর্তি স্পষ্ট তো নয়ই বরং খুবই অস্পষ্ট। আকাশের গায়ের ঝুলন্ত ধবধবে রূপালি চাঁদটা যখন পৃথিবীর মাটিতে নেমে আসে তখন একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব মানুষের অবয়ব থেকে এমন একটা ছায়ামূৰ্ত্তি গড়ে তুলতে। সত্যি, একমাত্র চাঁদ ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব এমন একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটাতে। কিন্তু সে ছায়ামূর্তিটা কীসের? কোনো মানুষের কি? না, অবশ্যই নয়। তবে? তবে কি কোনো দেবতার ছায়ামূর্তি?
মানুষের নয়, দেবতার ছায়ামূর্তিও নয়, এমনকি কোনো পরিচিত কারোই নয়, আজব ব্যাপার তো!
যাক গে, সদ্য আবির্ভূত ছায়ামূর্তিটা কি করল? নিশ্চল-নিথর পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েই রইল কি? না, নিশ্চয়ই যদি থাকবে তবে আর মিছেমিছি আর্বিভূত হতেই বা যাবে কেন?
ছায়ামূর্তিটা কয়েকমুহূর্ত পর্দার আড়ালে থেকে নড়াচড়া করল। তারপর আচমকা পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে পিতলের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সেটা যেন থেকে থেকে এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরাতে লাগল।
কিন্তু অনুসন্ধিৎসু নজরে ছায়ামূর্তিটার দিকে তাকিয়ে থেকেও কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হলো না, ছায়ামূর্তিটা কীসের? না, মানুষের তো অবশ্যই নয়, গ্রীসের দেবতারও নয়। ফ্যালাডিয়ার দেবতার তো নয়। এমনকি মিশরের দেবতার ছায়মূর্তি নয়। তবে? না, কোনো সিদ্ধান্তই নেওয়া সম্ভব হলো না যে, ছায়ামূর্তিটা কীসের!
তবে? এ আশ্চর্য ব্যাপারই বটে। আর্বিভুত ছায়ামূর্তিটা কীসের? আবার চোখ দুটোকেও তো অবিশ্বাস করা যায় না। অস্পষ্ট, খুবই অস্পষ্ট হলেও সেটা সে একটা ছায়ামূর্তি এতে তিলমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই, থাকার কথাও নয়।
হ্যাঁ, ওই, ওই তো সে ছায়ামূর্তিটা দরজায় খিলানের তলায় দাঁড়িয়ে।
এবার সে দরজার পাল্লায় হেলান দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় দাঁড়িয়ে একচুলও নড়াচড়া করছে না। ঠিক যেন একটা পাথরের মূর্তি নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এতটুকুও নড়ল তো না-ই, এমনকি কথা বলা তো দূরের ব্যাপার টু-শব্দটিও করল না।
এখন আমার যেটুকু মনে আছে, অর্থাৎ ঝাপসা স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে বলতে পারি, দরজাটা ছিল তরুণ সৈলাসের শবদেহের, আচ্ছাদিত শবদেহের পায়ের কাছে।
আমরা যে সাতজন সেখানে উপস্থিত ছিলাম সবাই এমন একটা অভাবনীয়, রীতিমত অবিশ্বাস্য একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে ধরতে গেলে পৌনে মরা হয়ে গিয়েছিলাম। কোনো কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি কারোই চোখ মেলে বুক কাঁপানো ছায়ামুর্তিটার দিকে তাকানোর সাহসও হলো না।
ছায়ামূর্তিটার দিকে কিছুতেই তাকাতে না পেরে শেষপর্যন্ত আমরা সবাই ভীত সন্ত্রস্ত চোখে আবলুস কাঠের আয়নাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তারপর একসময় ওইনসই, আমি গলা নামিয়ে, প্রায় ফিসফিসিয়ে দুএকটা কথা বললাম।
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় কোনো রকমে ছায়ামূর্তিটার নাম-ধাম জানতে চাইলাম।
আমাদের কথার জবাব না দিয়ে ছায়ামূর্তিটা আগের মতোই দরজায় হেলান দিয়ে নীরবে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েই রইল।
আমি সাহসে ভর করে অপেক্ষাকৃত গলা চড়িয়ে এবার ছায়ামূর্তিটাকে বললাম– ‘তোমার নাম কী হে? কোথায় থাক, মানে তোমার ঠিকানা কী?
ছায়ামূর্তিটা ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দিল–‘আমার নাম-টাম নেই, একটা ছায়ামূর্তি। ব্যস, এটুকু জেনেই সন্তুষ্ট থাক।
‘সে না হয় হল। কিন্তু তোমার ঠিকানা তো একটা না একটা আছেই। তোমার ঠিকানাটা?’
‘ময়লা পানির খাল–ফেরোলিয়াম খালের নাম শুনেছ কী?
‘হ্যাঁ, তা শুনেছি বটে।
‘সে খালের তীরবর্তী হেলুসিয়ন প্রান্তরের কাছাকাছি টোলেমাইস নামক সমাধিক্ষেত্র আছে, জান নিশ্চয়?
‘তা-ও জানি বটে।
‘সে সমাধিক্ষেত্রটাই আমার ঠিকানা, মানে সেখানেই আমি থাকি।’
ছায়ামূর্তিটার কথা কানে যেতেই আমরা সবাই এক সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে তড়াক্ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমাকে সর্বাঙ্গ বলি প্রদত্ত পশুর মতো থরথর করে কাঁপতে লাগল।