আমার ছোঁয়া পাওয়ামাত্র তার সর্বাঙ্গ অস্বাভাবিক কুঁকড়ে গেল। বিদ্যুৎগতিতে এক ধারে সরে গেল। যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত শবাচ্ছাদনের বস্ত্রখণ্ডটা মাথা থেকে খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তার খোলা, এলোমেলো কুচকুচে কালো চুলগুলো বাতাসে আরও ছড়িয়ে পড়ল। আমি বিস্ময় মাখানো অপলক চোখে নীরবে মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমার চোখের সামনে সে মূর্তিটা ধীরে-ধীরে চোখের পাতা দুটো মেলল।
আমি উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে উঠলাম–‘তুমি! শেষপর্যন্ত সেই তুমি, তুমি এলে! ভুল না, কিছুতেই না। কিছুতেই আমার ভুল হতে পারে না। সেই আয়ত চোখ, কালো, উদাসিন চোখ দুটো তো আমার হারিয়ে-যাওয়া প্রেয়সী, আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে আজও জাগরুক সেই। সেই লেডি লিজিয়ার চোখ দুটোকেই আমি দেখছি।
শ্যাডো–এ প্যারাবল
আপনারা, যারা পাঠক তাঁরা তো এখন দিব্যি জীবিত আছেন। কিন্তু আমি যে লেখক, বহু আগেই আমি ছায়ার দেশের বাসিন্দা হয়ে গেছি। আমি এখন অন্য লোকে দিন গুজরান করছি।
আমার এ স্মৃতিকথা মানুষের নজরে পড়ার আগে বহু অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটবে, বহু গোপন ব্যাপার স্যাপার প্রকাশ পেয়ে যাবে, পার হয়ে যাবে বহু শতক। আরও, আরও অনেক কিছুই ঘটবে।
আর আমার এ স্মৃতিকথা যখন মানুষের নজরে পড়বে তখনও কেউ করবে, কেউ বা সন্দেহের চোখে দেখবে, আর লোহার স্কাইলাস দিয়ে খোদাই করে করে যে বর্ণগুলো ফুটিয়ে তুলছি, তাতে কেউ কেউ বহু চিন্তার সুযোগ পাবে, হাজারো চিন্তার তথ্য।
সেটা এক আতঙ্কের বছর ছিল, আর আতঙ্কের চেয়েও তীব্রতর এক অনুভূতির, যার নামকরণ পৃথিবীতে আজ অবধি সম্ভব হয়নি।
বহু অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে গিয়েছে, দেখা দিয়েছে বহু লক্ষণ, আর জলে-স্থলে ও দূরবর্তী নিকটবর্তী অঞ্চলে সর্বত্র মহামারীর কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে। যাদেও ভগ্য ভালো তারা আঅবধি জানে না যে, স্বর্গেও এ ব্যাধির বীজ ছড়িয়ে পড়েছে।
আমি, আর আমি গ্রীক ওইলও পরিষ্কার অনুধাবন করতে পেরেছি, সাতশো চুরানব্বইতম বছরের সে কল্পকালের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, যখন মেষরাশির সঞ্চারের মাধ্যমে শনিগ্রহের ভয়ঙ্কর রক্তিম বলয়ের সঙ্গে বৃহস্পতির মিলন ঘটেছে।
আমার যদি অস্বাভাবিক ভুল না হয়ে থাকে, দূরবর্তী আকাশের ওই শক্তিগুলোর প্রভাব যে কেবলমাত্র পৃথিবীর বলয়ের ওপর পড়ে প্রভাবান্বিত করেছে এমন কথা মনে করা ঠিক হবে না, মানুষের কল্পনার ওপরও অবশ্যই প্রভাব পড়েছে। আর এটা যে হতেই হবে।
রক্তাভ চীনা মদের বোতলের ছিপি খুলে এক রাতে একটা বড়সড় হলঘরের মধ্যে আমরা সাতজন মুখোমুখি বসেছিলাম। সেটা ছিল টোলেমাইস নগরের একটা হলঘর। সেটাতে ঢোকার পথ একটাই। পিতলের উঁচু আর চওড়া একমাত্র দরজার কথা বলছি। এটা ছাড়া হলঘরটায় ঢোকার আর দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না।
কারিনোস নামক এক মিস্ত্রি দরজাটার নির্মাতা। এমন অত্যাশ্চর্য কৌশলে দরজাটা নির্মাণ করা হয়েছিল যে, সেটাকে কেবলমাত্র বন্ধ করা সম্ভব।
হলঘরটায় আলো-আঁধারী বিরাজ করত। তার দরজায় ঝোলানো একটা কালো পর্দা আকাশ, তারা, চাঁদ আর জনমানবশূন্য রাস্তাঘাটকে সর্বদা আড়ালে রাখত। সবকিছুকে আড়ালে আবডালে রাখলেও অশুভের পূর্বাভাষ আর অতীত স্মৃতিকে আড়াল করে রাখা সম্ভব হয়নি।
এমনকিছু বাস্তব আর অবাস্তব আমাদের চারদিকে বিরাজ করছিল যার কোনো স্পষ্ট বিবরণ আমার দেওয়া সম্ভব নয়। জগদ্দল পাথরের মতো ভারী একটা ভার যেন আমাদের মাথার ওপর ঝুলন্ত অবস্থায় বিরাজ করছিল। বিরাজ করছিল আমাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ওপর। বিরাজ করছিল আমাদের আসবাবপত্র আর পানপাত্রগুলোর ওপর।
আর সে ভারের চাপ সহ্য করতে না পেরে, ভারের চাপে সবকিছু যেন নিচে নেমে আসছিল। সবকিছুর কথা বললাম বটে, কিন্তু কেবলমাত্র মাথার ওপরের ঝুলন্ত সাতটা লোহার বাতিদান যেখানে অবস্থান করছিল, সেখান থেকেই দীর্ঘ ও সরু আলোর রেখা ছড়িয়ে পড়েনিস্তর-নিথরভাবে অনবরত জ্বলতে লাগল।
আমরা যে আবলুশ কাঠের টেবিলটায় বসেছিলাম, আলোর রেখাগুলো তার ওপর পতিত হয়ে যেন রীতিমত একটা আয়নায় রূপান্তরিত হল। তার সে আয়নাটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আমরা সবাই নিজের নিজের মুখচ্ছবি আর সঙ্গিদের চঞ্চল চোখের মণি দেখতে পেলাম।
তবু আমরা গলা ছেড়ে হাসতে আরম্ভ করলাম আর উদ্ভট আনন্দের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিলাম। আর গলা ছেড়ে অ্যানাক্ৰিয়নের যেসব গান ধরলাম, তাকে পাগলামি ছাড়া আর কী ই বা অ্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে? আর টকটকে লাল মদ রক্তের কথা মনে করিয়ে দিলেও আমরা সে মদ গিলে গিলে বুঁদ হয়ে গেলাম।
আমরা ছাড়া আরও একজন বাসিন্দা আমাদের ঘরে উপস্থিত ছিল। সে এক যুবক। তার নাম সৈলাস। সে টানটান হয়ে শুয়েছিল। আর তার মৃতদেহটা কফিনে মোড়া ছিল। তাকে বিশেষ দৃশ্যটার খলনায়ক ভাবা যেতে পারে।
উফ! কী অভাবনীয় কাণ্ড! আমাদের হৈ হট্টগোল, আনন্দ ফুর্তির মধ্যে নিজেকে কিছুতেই জড়ায়নি। কেবলমাত্র তার প্লেগরোগে বিকৃত মুখাবয়ব আর মৃত্যুর জন্য আধা-বিকৃত চোখ দুটোর দিকে নজর পড়ায় মনে হল, আমাদের আমোদ-উল্লাসে সে ঠিক ততটাই অংশগ্রহণ করেছে যতটা আগ্রহ একটা একজন মৃত ব্যক্তির পক্ষে দেখানো সম্ভব। আসন্ন মৃত্যু জনা কয়েকের আমোদ-আহ্লাদে।