গাল দুটো আর কপালে আবার কিছুটা আলোর আভা ফিরে এসেছে, সর্বাঙ্গে ঈষদুষ্ণতা লক্ষিত হচ্ছে, আর বুকের ধুক ধুক্ শব্দটাও তাতে জানান দিচ্ছে।
মহিলার দেহে প্রাণের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে, বেঁচে উঠেছে। তাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য দ্বিগুণ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম।
এক চিলতে ন্যাকড়া ঠাণ্ডা পানি ভিজিয়ে তার কপাল আর হাত দুটো ভালো করে মুছিয়ে দিলাম। অভিজ্ঞতার ঝোলা ঝেড়ে এমন সব পদ্ধতিতে কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম চিকিৎসাশাস্ত্রে যার হদিস মিলবে না। কিন্তু সবই ছাইয়ে পানি ঢালার সামিলই হয়ে গেল।
তার গাল আর চোখের পাতা দুটোর রক্তিম ছোপটুকু একেবারেই হঠাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, নাড়ির গতি স্তব্ধ হয়ে গেল, ঠোঁটে দুটোতে মৃত্যুর ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। আর চোখের পলকে সর্বাঙ্গ বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে এলো আর পাণ্ডুরতাও কাঠিন্য ভাবটাও স্পষ্ট হয়ে উঠল। আর দীর্ঘদিন কারাযন্ত্রণা ভোগ করছে এখন মানুষের দেহে যে সব লক্ষণ দেখা দেয় সে সবই তার দেহে এক-এক করে প্রকট হয়ে উঠতে লাগল।
আবার হ্যাঁ, আবারও আমি লিজিয়ার স্বপ্ন দৃশ্যগুলোর মধ্যে আমি পুরোপরি নিমজ্জিত হয়ে পড়লাম! এ কী অদ্ভুত কাণ্ড! লিখতে গিয়ে আমার হাত, আমার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে কেন? এ কী হাল হলো আমার।
আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আবলুস কাঠের খাটটা থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আমি সে কান্নার করুণ স্বর স্পষ্ট শুনতে পেলাম।
কিন্তু আমার সে রাতের ভয়-ভীতির বিস্তারিত বিবৃতি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে কি? আর ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগে পর্যন্ত রাতভর আমি কিভাবে এরকম একই জীবন-মৃত্যুর ভয়ঙ্কর নাটকের দৃশ্য মর্মাহিত হয়েছি, কেনই বা বলব? নিষ্ঠুর মৃত্যু প্রতিবারে কিভাবে ফিরে এসেছিল, কিভাবেই বা অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে আমাকে যন্ত্রণাকাতর হৃদয়ে কঠিন সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছিল তা তো আমি নিজেই ভালোভাবে জানি না, অন্যের কাছে সে বিবরণ কি করেই বা তুলে ধরা সম্ভব? আর এও আমার বিন্দু বিসর্গও জানা নেই। প্রতিটা সংগ্রামের পরিণতিতে মৃতার দেহে অত্যাশ্চর্য, নিতান্তই অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটেছিল?
অভিশপ্ত, ভয়ঙ্কর রাতটা ফুরিয়ে আসছে। যে মহিলার মৃত্যু হয়েছিল সে আর তিরতির করে কাঁপতে লাগল, নড়ে উঠল। এবারের মৃত্যুটা যদিও পূর্বের অন্যান্য মৃত্যুর চেয়েও অধিকতর ভয়ঙ্কর, তবু সে অপেক্ষাকৃত জোরে নড়ে চড়ে উঠল।
আমি মুহূর্তের জন্য তার দিকে তাকিয়েই ঝট করে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আকস্মিক ভয়ে একেবারে শক্ত কাঠ হয়ে গিয়ে অটোমানটার ওপর নিজেকে সঁপে দিয়ে হাত-পা ছেড়ে পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল-নিথরভাবে বসে রইলাম। একের পর এক ভয়ঙ্কর সব অনুভূতি আর আতঙ্কের শিকার হওয়াতেই আমার এ হাল হয়েছে।
একটু পরে আমি খাটটার দিকে আড় চোখে তাকালাম। দেখলাম, অভাবনীয় শক্তিতে তার মুখ জুড়ে জীবনের রঙ ঝলমলিয়ে উঠল। হাত-পা অবশ হয়ে এলো। আর আমি, আমি হয় ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি, রোয়েনা বুঝি শেষমেষ মৃত্যুর শৃঙ্খলাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। মৃত্যুকে সে তিলমাত্র পরোয়া করে না।
আমি স্বপ্নে বিভোর হয়ে সবকিছু দেখছিলাম কিনা আমার পক্ষে নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে আমার মধ্যে কিছুমাত্রও সন্দেহ রইল না যখন চোখের সামনে দেখলাম। যেন বিছানায় উঠে বসল, ধীরে-ধীরে একের পর এক কাঁপা-কাঁপা পা দুটো নামিয়ে খাট থেকে নেমে মেঝের কার্পেটের ওপর দাঁড়াল, চোখ দুটো বন্ধ রেখে চলতে-চলতে স্বপ্নবিষ্ট মানুষের মতোই আচ্ছাদিত সে মৃতদেহটা সাহস সঞ্চয় করে গুটি গুটি ঘরটার একেবারে কেন্দ্রস্থলে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার সর্বাঙ্গ অনবরত টলেই চলেছে।
আমি এতটুকুও নড়লাম না, সামান্যতম কাঁপলামও না। কেন? এর কারণ, সে মূর্তিটার হাবভাব প্রত্যক্ষ করায় অকল্পনীয় ও অবর্ণনীয় হাজারো কল্পনা আমার মাথায় ভর করে কিলবিল করতে লাগল। সেগুলোই আমার সবকটা ইন্দ্রিয়কে বিকল করে দিয়ে আমাকে পরোপুরি পাথরের মূর্তিতে পরিণত করে দিয়েছে।
আমি স্থবিরের মতো অটোমানটায় বসে মুখে কলুপ এঁটে ছায়ামূর্তিটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলাম। আমি যেন কেমন তাল হারিয়ে বসলাম। মাথার মধ্যে শুরু হয়ে গেল অস্থির তুমুল কাণ্ড।
কে? কে ওখানে দাঁড়িয়ে? জীবিত রোয়েনা-ই কী আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে? রোয়েনাই বটে–সেই নীলাক্ষী লেডি রোয়েনা ত্ৰিভানিয়ন-ই তো সে?
কেন? কেন দ্বিধা, এ সন্দেহ কেন আমার মনে দানা বাঁধল? আমি তো তার জীবদ্দশার গোলাপি গাল দুটোই দেখছি, কথা ঠিক কিনা? হ্যাঁ, জীবিত লেডি রোয়েনা র রক্তিম দুটো গালই তো আমার চোখের সামনে দেখছি। এ যে সেই পরিচিত চিবুক, সেই সুস্পষ্ট তিলটা–তারই কি নয় এগুলো নাকি অন্য কারো? তা-ই বা কি করে হয়?
কিন্তু, কিন্তু রোয়েনা কি আগের চেয়ে আরও একটু লম্বা হয়ে গেছে? হ্যাঁ, সে রকমই যেন মনে হচ্ছে, নাকি আমারই ভুল?
ধৎ! এ চিন্তাটাই সবচেয়ে বেশি করে আমাকে অস্থির করে তুলছে। আমি যেন। পুরোপুরি পাগল হয়ে পড়েছি।
নিদারুণ অস্থিরতার শিকার হয়ে আমি আচমকা একটা লাফ দিয়ে সবাচ্ছনে নিজেকে ঢেকেঢুকে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিটার একেবারে পায়ের কাছে হাজির হলাম।