মৃতদেহটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই আমি পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলাম। ঠিক সে মুহূর্তেই আমার স্বপ্নসাধের লিজিয়া-র গুচ্ছের খানেক স্মৃতি আমার মাথায় এসে ভিড় করল। উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের দুর্বার স্রোতের মতো আমার অন্তরকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল সে অবর্ণনীয় ব্যথা-বেদনা যা আমি তার মৃতদেহ আগলে বসে থাকার সময় অনুভব করেছিলাম।
রাত শেষ হতে চলেছে। একটু পরেই পূর্ব-আকাশের গায়ে রক্তিম ছোপ ফুটে উঠবে। তখনও আমার যে একমাত্র প্রেয়সীর তিক্ত চিন্তায় বুকভরে নিয়েনিস্পলক চোখে রোয়েনা-র প্রাণহীন দেহটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধই রাখলাম।
তখন হয়তো বা মাঝরাতই হবে। আবার তার কিছু আগে পরও হতে পারে। আসলে সময়ের হিসেব আমার ছিল না। আফিমের নেশার ঝোঁকে সময়ের হিসেব টিসাব করা আমার পক্ষে সম্ভবই ছিল না। যাক, তখন হঠাৎ শান্ত অথচ খুবই পরিষ্কার চাপা কান্নার স্বর আমার কানে বাজল। কান্নাটা শোনামাত্র আমার নেশা ঝোঁক, তন্দ্রাভাবটা একেবারে হঠাই কেটে গেল।
আমি তৎক্ষণাৎ যন্ত্রচালিতের মতো সোজাভাবে বসে গেলাম। উকর্ণ হয়ে কান্নার উৎসটা আবিষ্কারে মন দিলাম। মনে হলো আবলুশ কাঠের ঘাটটার ওপর থেকেই মৃত্যুর কান্নাটা ভেসে আসছে।
আতঙ্কিত দুরু দুরু বুকে আবার উত্তর্ণ হয়ে রইলাম। কিন্তু অবাঞ্ছিত শব্দটার পুনরাবৃত্তি ঘটল না।
ঘাড় ঘুরিয়ে ঘাটের ওপর শায়িত মৃতার দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে সতর্কতার সঙ্গে তাকালাম, মৃতদেহটা কোনোরকম গতি পরিবর্তন করেছে কিনা। না, সে রকম কোনো ঘটনাই আমার চোখে পড়ল না।
কিন্তু কিন্তু আমার শোনার ভুল বলেও তো মেনে নিতে উৎসাহ পাচ্ছি না। শব্দটা যত অস্পষ্টই হোক না কেন আমার কানে তো ঠিকই বেজেছে। আর তো শোনামাত্র আমার অন্তরাত্মা সচেতন হয়ে উঠেছে।
অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শবদেহটার দিকে আমার মন আর দৃষ্টিকে আবদ্ধ করে রাখলাম।
এক-এক মুহূর্ত করে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেল। তবু সে রহস্যটা ভেদ করা কিছুতেই সম্ভব হলো না।
শেষপর্যন্ত এক সময় আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, ক্ষীণ অথচ খুবই ম্লান একটা প্রায় অদৃশ্য একটা রঙের প্রলেপ যেন তার গালে আর চোখের পাতার সূক্ষ্ম শিরাগুলোতে লেগে রয়েছে।
এক বিশেষ অনুচ্চারিত আতঙ্ক ও ভীতির সঙ্গে মানবীয় কোনো ভাষায় যার ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়–আমার হৃদযন্ত্রের ধুকপুকানি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। স্থবিরের মতো আমি যেখানে ছিলাম ঠিক সেখানেই বসে থাকলাম, একচুলও নড়লাম না। তবু কর্তব্যজ্ঞানই আমাকে শেষপর্যন্ত নিজেকে সামলে রাখার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিল।
না। আমার মনে তিলমাত্র সন্দেহই রইল না যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন আমরা একটু আগেই সেরে রেখেছি। রোয়েনার দেহে এখনও প্রাণের চিহ্ন বর্তমান, জীবিতই রয়েছে। যত শীঘ্র সম্ভব কিছু একটা করতে হয়। কিন্তু চাকরবাকরদের বাসস্থল থেকে গম্বুজটার দূরত্ব বেশ কিছুটা। চিৎকার করে ডাকলেও কারো সাড়া মিলবে না।
ঘর থেকে বেশ কিছুক্ষণের জন্য বাইরে না গেলে সাহায্য-সহযোগিতা করার মতো কাউকেই ডেকে আনার কোনো রাস্তাই নেই। কিন্তু তা করা আমার সাহসে কুলিয়ে উঠল না।
তাই সে আত্মাটা এখনও এখানেই ঘুরপাক খাচ্ছে, আমি একাই তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সচেষ্ট হলাম।
তবে অল্পক্ষণের মধ্যেই লক্ষ্য করলাম রোগীর পরিস্থিতি আবার ক্রমে খারাপ হয়ে উঠছে, রোগের প্রকোপ বেড়েই চলেছে।
রোগীর গাল আর চোখের পাতার রক্তিম ছোপটুকু ক্রমেই উঠে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে।
রোগী কোঁচকালো ঠোঁট দুটোকে একত্র চেপে ধরেছে। আর তাতে মৃত্যুর ভয়ঙ্করতা প্রকাশ পাচ্ছে।
রোগীর গায়ে হাত দিয়ে আমি নতুন করে চমকে উঠলাম। দেখলাম, তার সর্বাঙ্গ বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে আর শরীর ক্রমেই দ্রুত কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে।
আমার সর্বাঙ্গ আবার কম্পন দেখা ছিল। আমি আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে আবার অটোমানটায় ধপাস করে বসে পড়লাম। লিজিয়া-র জাগ্রত ছবিগুলো আবার নতুন করে ক্রমান্বয়ে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল।
নিদারুণ আতঙ্ক আর অস্থিরতার মধ্য দিয়ে একটা ঘণ্টা কেটে গেল। ঠিক যে মুহূর্তেই আমার কানে দরজার দিক থেকে দু-একটা অস্পষ্ট শব্দ আমি শুনতে পেলাম, কিন্তু এ কি করে হতে পারে?
শব্দগুলো শোনামাত্র আমার বুকের মধ্যে ধুক পুকানি শুরু হয়ে গেল। আতঙ্কে আমার সঙ্গি আড়ষ্ট হয়ে আসতে লাগল। আবার-আবারও সে অবাঞ্ছিত শব্দটা শুনতে পেলাম, পর মুহূর্তেই শুনতে পেলাম একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস।
আমি যন্ত্রচালিতের মতো মৃতদেহটার ওপর ঝুঁকে দেখতে পেলাম স্পষ্ট দেখতে পেলাম, ঠোঁটে দুটো তিরতির করে কাঁপছে।
মিনিট খানেক পরেই কাঁপা-কাঁপা ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হতেই চোখের সামনে মুক্তোর মতো চকচকে ঝঝকে দাঁতের পাটি স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল। আতঙ্কে আমার শরীরের সব কটা স্নায়ু যেন এক সঙ্গে বিকল হয়ে পড়তে লাগল আর বুকের ভেতরে বয়ে চলল উদ্দাম সমুদ্রের ঢেউ।
আমি উপলব্ধি করতে পারলাম। আমার দৃষ্টি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে, বুদ্ধি বিবেচনা ভোতা হয়ে পড়ছে, আমি যেন ক্রমেই ঝিমিয়ে পড়ছি।
শেষপর্যন্ত প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করার মতো শারীরিক ও মানসিক বল ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলাম।