আবলুস কাঠের রোগ শয্যার এক গায়ের একটা ভারতীয় অটোমানে বসে আমি তার অস্বাভাবিক মুখটার ওপর-দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। সে দুর্বল হাত দুটোর ওপর ভর দিয়ে কোনোরকমে কঙ্কালসার শরীরটাকে সামান্য তুলল। অনুচ্চকণ্ঠে ধরতে গেলে একেবারে ফিসফিস্ করে সে বলল। জান, এইমাত্র সে শব্দটা শুনলাম! এই তো, এই মাত্র!
অথচ আমার কানে কিছুই ধরা পড়েনি।
এই তো, এখনই সে কাকে যেন হাঁটাচলা করতে দেখেছে। সে দেখেছে, অথচ আমার চোখে কিছুই পড়ল না।
আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম, তুফানের মতো তীব্র বাতাস পিছন থেকে ধেয়ে ক্রমে পর্দার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
আমি তার কথা শুনে একবার ভাবলাম। সে যাকে ফিসফিসা নিভেবে আতঙ্কিত হচ্ছে তা আসলে অস্ফুট নিশ্বাসের শব্দ, ঘরের মূর্তিগুলোর বাতাসে লে খাওয়া তুফানের মতো হাওয়ার স্বাভাবিক পরিণতি ছাড়া অন্য কিছুই নয়।
আমি এ ব্যাপারে কিছু বলব কি বলব না ভাবছি ঠিক তখনই তার মুখ অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে উঠল। সে দৃশ্য েেখ আমি নিঃসন্দেহ হলাম। এসব ব্যাপার তাকে বুঝিয়ে বলে স্বস্তিদান করার চেষ্টা করা নিছকই পন্ডশ্রম ছাড়া কিছুই নয়।
তার পরিস্থিতি দেখে আমি বুঝতে পারলাম। সে বুঝি সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়বে। ডাকাডাকি করেও তার সাড়া পাওয়া যাবে না।
তখন হঠাৎই আমার মনে পড়ে গেল, চিকিৎসকের পরামর্শনুযায়ী এক বোতল মদ কিনে এনে ঘরে রেখেছিলাম। ব্যস্ত হয়ে উঠে সেটা আনার জন্য এগিয়ে গেলাম।
হেঁটে সে ঝুলন্ত বাতি দানটার নিচে গিয়ে দাঁড়ানোমাত্র এমন দু-দুটো অত্যাশ্চর্য, অবিশ্বাস্য ঘটনার দিকে আমার দৃষ্টি আকৃষ্টহল।
সত্যি আমি রীতিমত চমকে উঠলাম। অদৃশ্য হলেও আমার মনে হলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোনো লোক বা অন্য কিছু ধীরে মন্থর গতিতে আলতো পায়ে আমার পাশ দিয়ে প্রায় গা-ঘেঁষে লে গেল।
শুধু কি এ-ই? আরও লক্ষ্য করলাম, বাতি দানটা থেকে বিচ্ছুরিত উজ্জ্বল আলোক রশ্মির ঠিক কেন্দ্রস্থলে পেতে রাখা সোনালি গালিচাটার ওপরে একটা ছায়া স্থিরভাবে অবস্থান করছে। অনুসন্ধিৎসু নজর মেলে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, দেবদূতের আকৃতিবিশিষ্ট, অনির্দিষ্ট একটা ছায়ামূর্তি। সঠিকভাবে বললে সেটা আধো আলো আধো ছায়ার একটা মূর্তি। একে আলোর ছায়াও মনে করা যেতে পারে।
কিন্তু আফিমের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি হয়ে যাওয়ার দরুণ আমার নেশাটা যেন বেশ চড়েই গিয়েছিল। তাই ও ব্যাপার স্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানো থেকে নিজেকে সরিয়েই রাখলাম। আর এ ব্যাপারে রোয়েনের কাছেও মুখ খুললাম না, পুরোপুরি চেপেই গেলাম।
হাত বাড়িয়ে মদের বোতলটা নিয়ে মূৰ্হিতা মহিলার বিছানার কাছে ফিরে এলাম। সেটা থেকে এক পেয়ালা মদ ঢেলে তার কাঁপা কাঁপা ঠোঁট দুটোর সামনে ধরলাম।
ইতিমধ্যে সে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। নিজেই শীর্ণ-দুর্বল হাত বাড়িয়ে আমার কাছ থেকে মদভর্তি পেয়ালাটানিল। আমি এবার অটোম্যানার ওপর শরীর এলিয়ে দিয়ে অপলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
সে মুহূর্তেই হ্যাঁ, ঠিক সে মুহূর্তেই গালিচার ওপর থেকে মৃদু একটা পদধ্বনি আমার কানে এলো। আমি সচকিত হয়ে পড়লাম। এর এক সেকেন্ড পরেই রোয়েনা হাতের মদের পেয়ালাটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে গেল। ঠিক সে মুহূর্তেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, অথবা আমি হয়তো স্বপ্নই দেখলাম, ঘরের ভেতরের কোনো গোপন ঝর্ণা থেকে চুনির মতো রঙের তরল পদার্থের তিন-চারটি ফোঁটা পেয়ালাটার ভেতরে পড়ল।
অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা আমি দেখলাম বটে, কিন্তু রোয়েনা-র চোখে কিছুই পড়ল না। ফলে সে নিঃসঙ্কোচে পাত্রের মদটুকু গলায় ঢেলে দিল। পুরো ব্যাপারটা আমি সতর্কতার সঙ্গে চেপে গেলাম, টু-শব্দটিও করলাম না।
তবু তো এত বড় সত্যটাকে আমার পক্ষে নিজের বুকের ভেতরে চেপে রাখা সম্ভব নয়। সত্যি কথা বলতে কি, ওই চুনি রঙের ফোঁটাগুলো দিয়ে মদটুকু রোয়েনার পেটে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শারীরিক পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকে যেতে লাগল। অবস্থা এত দ্রুত খারাপের দিকে মোড়নিল যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
সে ঘটনার পর তৃতীয় রাতেই আমার পরিচারিকারা নিজেরাই তার কবর খুঁড়ে ফেলল।
চতুর্থ রাত। সে রাতে ভৌতিক ঘরটার বিছানায় এলিয়ে পড়ে থাকা তার আচ্ছাদিত প্রাণহীন নিঃসাড় দেহটাকে আগলে আমি নিশ্চল-নিথর পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলাম। একদিন সে নতুন বৌ হয়ে এ ঘরেই গুটিগুটি ঢুকেছিল না!
আমার আফিমের নেশা তখন তুঙ্গেই রয়েছে। নেশার ঘোরে আমি দেখলাম, একেবারেই অত্যাশ্চর্য অভাবনীয় দৃশ্য একের পর এক আমার চোখের সামনে দিয়ে দ্রুত সরে যাচ্ছে, আবার তেমনই অভাবনীয়ভাবে ঘুরে ঘুরে আসছে।
ঠিক যে মুহূর্তেই আগেকার এক রাতের আর একটা অকল্পনীয় ঘটনা আমার মনের কোণে উঁকি দিয়ে উঠল, ঠিক সে মুহূর্তেই ঝুলন্ত বাতিদানিটার দিকে আমার চোখ পড়ল। সেদিন গালিচার যেখানে আমি অস্পষ্ট একটা ছায়ামূর্তি দেখেছিলাম। তবে এও সত্য যে, এ মুহূর্তে মূর্তিটা এখানে অনুপস্থিত। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি শ্বাস টেনে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানার ওপর শায়িত ও প্রায় আচ্ছাদিত ফ্যাকাশে বিবর্ণ ও কাঠের মতো শক্তনিষ্প্রাণ দেহটার দিকে তাকালাম।