গারদের ভেতরে আমি এখন ভাবছি, আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একদিন না একদিন আমার হাত পায়ের বেড়ি হয়তো খুলে যাবে। কিন্তু তারপর! তারপ আমার কি গতি হবে? আজ আমি জেলখানায় বসে আফসোস করছি কাল কোথায় আমার স্থান হবে?
শয়তানটার ভালোই জানা আছে।
ইলিওনোরা
সবাই আমাকে পাগল বলে।
আসলে মাত্রাতিরিক্ত কল্পনা আর আবেগের জন্য সবার কাছে পরিচিত এক বংশে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। যাক গে, সবাই আমাকে পাগল বলেই সম্বোধন করে।
কিন্তু আজ অবধি তো একটা প্রশ্নে মিমাংসা হয়নি, যে, উন্মাদনাই কি মহত্তম বুদ্ধিবৃত্তি? আবার যা-কিছু গৌরবময়, যে সব সুদৃঢ়, সে সবকিছুই ব্যাধিগ্রস্ত চিন্তার মাধ্যমেই সম্ভব কি না, সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধির বিনিময়ে লাভ করা মনের একটা উদারতম ভাব থেকে সৃষ্ট কি না, এ প্রশ্নের মীমাংসা করা তো আজ অবধি সম্ভব হয়নি।
সমাজের যে সব মানুষ দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে তাদের পক্ষে এমন বহু কিছু অবগত হওয়া সম্ভব। যা যারা কেবলমাত্র রাতে ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে তাদের ধ্যান-ধারণার বহিভূত রয়ে যায়। দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে তাদের পক্ষে অনন্তের ক্ষণিক দর্শন লাভ করতে সক্ষম হয়।
ঘুম চটে গেছে তাদের অন্তর এ-কথা ভেবে কেঁপে ওঠে যে তারা এক সুমহান গভীর রহস্যের একেবারে কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল। সম্পূর্ণ না হলেও খুব সামান্য
অংশের জন্য হলেও তারা জ্ঞানের এ-রূপকে কল্যাণময় বলেই উপলব্ধি করেছে। যা। আমরা সচরাচর জ্ঞান বলে দেখে থাকি তার চেয়ে অনেক বেশি কাম্য। আর তাদের জ্ঞান যতই লাগামছাড়া হোক না কেন তারা কিন্তু এক অনির্বচনীয় অবর্ণনীয় আলোর এক সুবিস্তীর্ণ মহাসাগরে প্রবেশ করেছে।
ঠিক আছে, আমি পাগল এটাই বলা হোক। আমি অন্তত এটুকু স্বীকার করে নিচ্ছি। যে, আমার মনের দু-দুটা পৃথক অবস্থা বর্তমান। একটা পরিষ্কার যুক্তির অবস্থা, যাকে বলব আমার প্রথম-জীবনের ঘটনা-দুর্ঘটনার স্মৃতিগুলো তার সাক্ষ্য বহন করছে, আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে অনুমান, সন্দেহ আর ছায়া ছায়া অবস্থা যা বর্তমান আর জীবনের দ্বিতীয় অবস্থা স্মৃতিগুলো। অতএব আমার জীবনের প্রথম অবস্থার কথা যা-কিছু আপনাদের সামনে তুলে ধরব সে সবই কিন্তু বিশ্বাস করবেন। আর দ্বিতীয় অধ্যায় সম্বন্ধে যা-কিছু বলব তাদের যথাযোগ্য প্রাপ্য বিশ্বাসটুকু দিতে কার্পণ্য করবেন না। আর তা যদি না ই সম্ভব হয় তবে সেগুলোকে সম্পূর্ণরূপে সন্দেহের চোখে দেখবেন, আপত্তি নেই। আর যদি তা নিতান্তই সম্ভব না হয় তবে ইডিপাস রহস্যকে নিয়ে খেলায় মেতে থাকবেন, কেমন?
এবার আমার মনের কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি–যৌবনে যাকে আমি অন্তরের ভালোবাসা নিঙড়ে দিয়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলাম, যার কথা ও কাহিনী নিয়ে এ স্মৃতিকথা লিখতে বসেছি, শান্ত-স্বাভাবিক আর স্পষ্টভাষায় ব্যক্ত করছি, সে আমার বহুদিন আগে পরলোকগতা মাতৃদেবীর একমাত্র বোনের একমাত্র কন্যারত্ন।
সে বোনের নাম ছিল ইলিওনোরা। আর এ নামেই তাকে সবাই সমোধন করে। আমরা প্রায় প্রতিটা মুহূর্ত একসঙ্গে পরস্পরের পাশাপাশি-কাছাকাছি অবস্থান করতাম। তৃণাচ্ছাদিত উপত্যকায় গ্রীষ্মমণ্ডলের সূর্যরশ্মির নিচে আমরা উভয়ে একত্রে কাটিয়েছি। সেটা ছিল এমনই একটা উপত্যাকা যেখানে পথপ্রদর্শক ছাড়া কেউ একা কোনোদিন যায়নি। এরও কারণ আছে যথেষ্টই। কারণ স্থানটা সুউচ্চ একটা পর্বতমালার কেন্দ্রে অবস্থিত। আর তার ভালোলাগা কথাগুলো মর্মরশ্মির প্রবেশাধিকার ছিল না।
আর! মানুষ চলাচলের কোনো পথ সে অঞ্চলটার কাছাকাছি দিয়ে এগিয়ে যায়নি। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের সে শান্তি-সুখের নীড়ে বনের ঝোঁপ ঝাড় গাছগাছালির কোনোটাকে দু হাতে সরিয়ে, না হয় কোনোটাকে ভেঙে তবেই যাওয়া যেত। আর লক্ষ লক্ষ সুগন্ধ ফুলকে দুপায়ে মাড়াতে হত। এ ভাবেই আমরা প্রতিদিন যাতায়াত করতাম। আমরা বলতে আমি, আমার বোনটা আর তার মায়ের কথা বলছি। আমরা এমনই সমাজ-সংসার থেকে দূরে, বহুদূরে একান্ত নির্জন-নিরালায় বাস করতাম। উপত্যকার বাইরেও সে এক বিশাল জগতের অস্তিত্ব রয়েছে তা আমাদের ধ্যান ধারণার বহির্ভূত ছিল।
আমাদের দেশটার চারদিক ঘিরে রেখেছিল যে পর্বতমালা, তারই শীর্ষদেশের এক স্থান থেকে উদ্ভুত একটা নদী পর্বত আর পার্বত্য বনাঞ্চলের গা-বেয়ে এঁকে বেঁকে হেলে দুলে ছোট্ট একটা নদী নেমে এসেছিল। আবার ঘুরে গিয়ে পাহাড়ারের কোনো এক অজ্ঞাত অঞ্চলে সেটা হারিয়ে গেছে। একমাত্র ইলিওনোরার চোখের মণি দুটো ছাড়া আর সবকিছুর চেয়ে স্বচ্ছ ছিল তার জলরাশি।
আমরা সে নদীটাকে নিঃশব্দের নদী বলে সম্বোধন করতাম। কেন? কারণ, তার প্রবাহে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক নীরবতা বিরাজ করত। আর আমরা যে নুড়ি পাথরগুলোকে খুবই ভালোবাসতাম সেগুলো পর্যন্ত নদীটার স্রোতের এক তিলও পড়ত না। গতিহীনতার জন্য সন্তুষ্ট হয়ে তারা যে, যার জায়গায়ই নিশ্চল-নিথরভাবে পড়ে থেকে ঝকমক করত। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য।
আমি আর আমার ভালোলাগা ইলিওনোরা–আমাদের অন্তরে প্রেমের আর্বিভাব ঘটার পনেরোটা বছর আগে আমরা পরস্পরের হাত ধরাধরি করে উপত্যকার সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর দিয়ে এখানে ওখানে কতই না ঘুরে বেরিয়েছি তার হিসেব নেই। তারপর আমার চতুর্থ পঞ্চাব্দ আর আমার তৃতীয় পঞ্চাব্দ যখন শেষ হতে চলেছে ঠিক তখনই আমরা পরস্পরকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে, বুকে জড়িয়ে ধরে সর্পিল গাছটার তলায় বসেছিলাম। সেখানে বসে নিঃশব্দের নদীটার পানিতে আমাদের চঞ্চল প্রতিচ্ছবি দেখতে লাগলাম। সে বহু আকাক্ষিত, মধুর দিনটায় অবশিষ্ট সময় আমরা কেউ-ই কারো সঙ্গে একটা কথাও উচ্চারণ করিনি।