আমার অন্তঃস্থলে সর্বক্ষণ যে নিরাপত্তাবোধ চক্কর মেরে বেড়াচ্ছে তা কখন যে আমার মুখ দিয়েও আচমকা বেরিয়ে এলো তা আমি খেয়াল করিনি।
পথ চলতে চলতে হঠাৎই বুঝতে পারলাম, আমি নিজের মনেই পাগলের মতো বক বক করে চলেছি–ধরবে? আমাকে ধরবে? কে আমার গায়ে হাত দেবে? কিছুমাত্রও প্রমাণ নেই, কোনো সূত্রও নেই, আর সন্দেহ করার মতো কারণও কিছু নেই। কে আমাকে ধরবে? কে ধরবে? আমিনিজে থেকে স্বীকার না করে নিলেই তো হলো! আমার গায়ে কাঁটার আঁচড় দেওয়ারও কারো সাধ্য নেই।
যখন বুঝতে পারলাম, ঠিক সে মুহূর্তেই আমার বুকের ভেতরে অস্বাভাবিক ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। তবে সে আর কতক্ষণ? খুবই অল্পক্ষণের জন্য। তা যদি
হতো তবে অনেক আগেই আমার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত। ব্যস, কেল্লা ফতে হয়ে যেত। এ কী কেলেঙ্কারি ব্যাপার! তবে কি শয়তান আমার কাঁধে ভর করেছে? হ্যাঁ, সে রকমই তো মনে হচ্ছে। তা নইলে আমার এমন আকস্মিক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটতে যাবেই বা কেন? মৃগী রোগের শিকার হলে মানুষ এমন করে আপন মনে প্রলাপ বকতে থাকে। হায়! এ কী সর্বনাশা কাণ্ড!
আমি অনবরত বকেই চললাম–হ্যাঁ, আমি খুন করেছি। খুন করেছি, বেশ করেছি। হাজার বার বলব, বেশ করেছি। এতদিন তো অন্তরের অন্তঃস্থলে গোপন। করেই চেপে রেখে দিয়েছি। কিন্তু এখন কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটতে শুরু করেছে রে বাবা! তবে কি…তবে কি নিহত বুড়োটার প্রেতাত্মাই আমাকে দিয়ে এসব কথা বলাচ্ছে! তবে কি এটা প্রেতাত্মারই কারসাজি।
আমার বুকের ভেতরের ধুকপুকানি মুহূর্তে যেন হাজার গুণ বেড়ে গেল। আমি কাণ্ডজ্ঞান রহিত অবস্থায় লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটা জুড়ে দিলাম। না, হাঁটা বললে ঠিক বলা হবে না, বরং উর্ধশ্বাসে দৌড়ানোই বলা উচিত। আমি সদর রাস্তা ছেড়ে দিয়ে গলিপথ ধরলাম। একের পর এক বাঁক ঘুরে, গলি পাল্টাতে পাল্টাতে রীতিমত উৰ্দ্ধশ্বাসে পথ পাড়ি দিতে লাগলাম। ছুটতে ছুটতে আপন মনেই ভাবতে লাগলাম, পাগলের মতো চেঁচিয়ে বলাই বরং উচিত। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে সবাইকে বলে দেওয়াই তো উচিত। বরং চেঁচিয়ে বলেই ফেলি–শোন, তোমরা সবাই শোন, আমি খুনি, খুন করেছি। আমি নিজেহাতে খুন করেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার গায়ে কাঁটার আঁচড়ও কেউ দিতে পারেনি। পারবেও না কোনোদিন!
আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে প্রায়োন্মাদের মতো ইচ্ছাটা যতবার তীব্রতর হয়ে উঠছে ততবারই আমি আতঙ্কে একেবারে কুঁকড়ে গিয়েনিজেকে কোনোরকমে সামলেসুমলে দমিয়ে রেখেছি।
আমি আতঙ্ক-জ্বরের শিকার হয়ে হাঁটার গতি বাড়াতে বাড়াতে রীতিমত দৌড়াতে শুরু করলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে নির্জন-নিরালা অঞ্চল ছেড়ে মানুষের ভিড়ের মধ্যে চলে এলাম। জোরে তখনও জোরে দৌড়াতে আরম্ভ করলাম। কাউকে ঠেলে, কাউকে গোত্তা মেরে আমি নিরবচ্ছিন্নভাবে দৌড়েই চললাম।
দৌড় লাগানো আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। আমি বুঝতে পারছি, এভাবে উন্মাদের মতো দৌড়ালে আমার আতঙ্কটা অনেকাংশে বেড়েই যাবে। আর সে সঙ্গে আমার প্রতি পথচারীদের মনে কৌতূহলের সৃষ্টি হবে। আর কৌতূহল থেকে মনে দানা বাঁধবে সন্দেহ। ব্যস, সর্বনাশের চূড়ান্ত ঘটে যাবে। কিন্তু হায়! আমি যে কিছুতেই দৌড় থামিয়ে স্বাভাবিক হতে পারছি না।
হায়! যা স্বাভাবিক, যা ঘটা উচিত ছিল তা-ই ঘটে গেল। উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো আমাকে অনবরত দৌড়াতে দেখে পথচারীদের একটা অংশ ধর! ধর রবে চিল্লাচিল্লি করতে করতে আমার পিছু নিল।
আমার বুঝতে দেরি হলো না অদৃষ্ট আমাকে শেষপর্যন্ত কোন দিকে নিয়ে চলেছে।
হায় ঈশ্বর! এ কী সর্বনাশ ঘটতে চলেছে! তখনও যদি আমার অবাধ জিভটাকে টেনে ছিঁড়ে ফেঁড়ে ফেলতে পারতাম,নির্ঘাৎ অব্যাহতি পেয়ে যেতাম। কিন্তু আমার মনের কোণে সদ্য জেগে-ওঠা জিভ ছেঁড়ার ইচ্ছাটা উঁকি মারতে না মারতেই আমার একেবারে কানের কাছে হেড়ে গলায় কড়া স্বরে কে যেন পিছন থেকে ধমক দিয়ে উঠল–হুঁশিয়ার! দাঁড়া! ব্যস আচমকা শক্ত একটা হাত আমার কাঁধটাকে সাড়াশির মতো চেপে ধরল।
ব্যস, আমার শরীরের সবটুকু শক্তি যেন মুহূর্তের মধ্যেই নিঃশেষে উবে গেল। আমার পথে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, সামান্য নড়তে চড়তেও পারলাম না। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে কালা মাছের মতো হাঁ করে অনবরত জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলাম। দম বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড় হয়ে আসছিল। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল। দৃষ্টিশক্তি যেন লোপ পেতে বসেছে। কানেও কিছু শোনা যাচ্ছে না। হায়! চোখ আর কান দুটোই একই সঙ্গে চলে গেল, অকেজো হয়ে পড়ল!
আমি কর্তব্য ভাববার আগেই অদৃশ্য শয়তানের মতো কার যেন বজ্রমুষ্ঠি আমার পিঠের ওপর দুম্ করে আছড়ে পড়ল না।
ব্যস, মুহূর্তের মধ্যেই অঘটনটা ঘটে গেল। অন্তরের অন্তরতম গোপন কোণে এতদিন যে কথাটাকে জোর করে চেপে রেখেছিলাম, সেটা অতর্কিতে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো।
পরে জানতে পারলাম, আমি নাকি খুবই স্পষ্টস্বরে আর খুবই ব্যস্ততার সঙ্গে আমার দোষ কবুল করেছিলাম–খোলাখুলি সবকিছু বলে ফেলেছিলাম। কথা বলতে গিয়ে যদি কিছু বাদ পড়ে, ছাড় ঘটে তাই মুহূর্তের জন্যও থামিনি।
আমার বুকের ভেতরে জোর করে চেপে রাখা কথাগুলোকে এক নিশ্বাসে বলেই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর যা-কিছু ঘটনা সবই আমার অজান্তে।