নিচের পাহাড়ের গায়ের ওই দুর্গ-শহরে কিছুক্ষণের মধ্যেই উপহার আসার কথা। নাদুসনুদুস ভেড়া জবাই করবে। তারপর সে মাংস দিয়ে শত্রুসৈন্যরা পরমানন্দে ভোজ সারবে।
শত্রুসৈন্যরা ছিন্নমুষ্ক।
কিন্তু পাহাড়ের গায়ের দুর্গ শহরের মানুষগুলো কিন্তু ছিন্নমুষ্ক না, সবাই বিধস্য। তাই শত্রুসৈন্যদের সঙ্গে তাদের আহার্য থেকে শুরু করে সবকিছুর দিক থেকে পার্থক্য তো থাকারই কথা। আত্মম্ভরী ছিন্নমুষ্ক সেনাপতি পাহাড়ের চূড়ায় বসে সদম্ভে স্বগতোক্তি করছে–আমরা উদারচিত্ত। আমাদের ঔদার্যের কথা লোকের কাছে বুক ফুলিয়ে বলার মতোই বটে। আমাদের সমতুল্য কাউকেই দেখছি না। দুর্গ শহরের মানুষগুলো তো আমাদের কাছে মেষ শাবকের তুল্য। দেবতাজ্ঞানে আমাদের পূজা করা ছাড়া তাদের কোনো গতিই নেই। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের কথায় তারা উঠছে-বসছে।
আমরা তাদের চারদিক থেকে অবরোধ করে রেখেছি। কেন? এর পিছনে কোন্ উদ্দেশ্য আছে, তাই না? আমরা তাদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেব। আমরা যদি অন্য ধান্ধা করতাম, সেলামিস্বরূপ মোটা টাকা চেয়ে বসতাম, অনায়াসে তা যে পেয়ে যেতাম, এতে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু আমরা ভুলেও সে পথে হাঁটলাম না। আমরা তো আর কাঙাল নই যে, অন্যের কাছে হাত পাততে যাব। তবে আমরা কি চাচ্ছি? মোটামোটিনাদুসনুদুস ভেড়া, জবাই করার জন্য, মজা করে ভুরিভোজ খাবার জন্য।
একটু পরেই বাঞ্ছিত বস্তু ওপর থেকে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো। ওপর থেকে ভেড়ার মাংস ভর্তি পেটি দড়িতে বেঁধে নিচে নামিয়ে দিল। পিঠে পাথর বেঁধে ভারি করা হল, যার জন্য দড়িটা টানটান হয়ে গেল।
বেশ কয়েকজন মিলে বাক্সটাকে টানাটানি করে তুলে নিল। এর জন্য তাদের বেশ কসরত করতে হয়েছে। গা দিয়ে রীতিমত ঘাম ঝড়ছে। যারা এতক্ষণ মাথা নুইয়ে বাক্সর চারপেয়ে প্রাণীটাকে দেখছিল, তারা সোল্লাসে বলতে লাগল। আরে বাস! দারুণ ভেড়া! খাসা ভেড়া। তাদের একজন দু বাহু তুলে উদ্দাম নৃত্য করতে করতে গলা ছেড়ে উল্লাস প্রকাশ করতে লাগল। বাজাও, কাড়া নাকড়া আর তুরীভেড়ি। গলাছেড়ে গান ধরো সবাই! কী মজা! খাসা ভেড়া! নাদুসনুদুস ভেড়া!
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ইয়া পেল্লাই বাক্সটা ওপরে উঠে গেল। বাক্সটার ঢাকনা খুলতেই শত্রুসৈন্যদের সবার মুখ আমসির মতো শুকিয়ে গেল।
ফ্যাকাশে-বিবর্ণ মুখে সবাই বাক্সটার দিকে তাকিয়ে রইল। কারো মুখেই বাক্ সরছে না। আর চোখের তারায় বিস্ময়ের সুস্পষ্ট ছাপ।
এমন সময় নাদুসনুদুস চারপেয়ে প্রাণী এক লাফে বাক্সটার ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। তবে এটা অবশ্যই ভেড়া নয়। সুবিশাল ছিন্নমুষ্ক শূকর। একেবারেই অপ্রত্যাশিত কাণ্ড।
যার নরম মাংস অতি পবিত্র বিরোচিত হয়–আহারের কথাও মুখে উচ্চারণ করতে নেই। তোবা! তোবা!
এ টেল অব দ্য র্যাগড মাউন্টেইনস
১৮০৭ সাল।
সে বছরের প্রথমের দিকে আমি ভার্জিনিয়ার চার্লোটিস ভিলাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতাম। এক সকালে একেবারেই অভাবনীয়ভাবে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় হয়। তাঁর নাম অগ্যাস্টাস বেড়লো।
মি. বেডলো ছিলেন বয়সে যুবক। আর সত্যিকারের ভদ্রলোক বলতে যা বুঝায় তিনি ছিলেন ঠিক সেই রকমই সজ্জন। তাঁর আচরণ ছিল অমায়িক, কথাবার্তায়ও সাধ্যমত শিষ্টতা বজায় রাখতে সাধ্যমত চেষ্টা করতেন। তার সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে যারপরনাই সৌহার্দ্যপূর্ণ সৌজন্যবোধের পরিচয় পেয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ি। আর এ কারণেই আমি তার সম্বন্ধে আরও কিছু জানা ও বোঝার জন্য নিরবচ্ছিন্ন কৌতূহলের শিকার হয়ে পড়ি।
মি. বেডলোর সম্বন্ধে বিশেষভাবে জানার আগ্রহ আমার যত গভীরই হোক না কেন, নীতিগত বা দেহগত সম্পর্কের দিক থেকেও তাকে যথাযথভাবে জানা ও চেনা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সাধ্যমত সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে সংযত রেখে খোঁজখবর নিয়েও তার পরিবার সম্বন্ধে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য সংগ্রহ করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। তিনি কোন অঞ্চলের লোক, কোথা থেকে যে এসেছেন, বহু চেষ্টা করেও করে এ-তথ্যটুকুও সঠিকভাবে জানতে পারলাম না। আর আমি তাকে যুবক বলে মনে করলেও তার বয়সের ব্যাপারেও আমি পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হতে পারলাম। কারণ, তার মধ্যে আমি এমনকিছু লক্ষ্য করেছি যা আমাকে তার বয়সের ব্যাপারে পাকাপাকি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারার জন্যই আমাকে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়েছে। এ-ই যদি সত্য হয় তবে আমি তাকে যুবক বলে বর্ণনা দিলাম কেন, তাই না? প্রশ্নটা খুবই সঙ্গত, অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আমার বক্তব্যের যুক্তিও আছে যথেষ্টই। আসলে প্রথম দর্শনেই ভদ্রলোককে আমার যুবক বলেই মনে হয়েছিল। আবার তিনি কথা প্রসঙ্গে প্রায়ই যৌবনের কথা বলতেন। তবুও মাঝে মধ্যে তিনি এমন সব কথাও বলতেন যার ফলে তাঁকে যুবক মনে করা তো দূরের ব্যাপার একশো বছরের এক বৃদ্ধ মনে করতেও এতটুকুও দ্বিধা আমার মধ্যে সঞ্চারিত হত না। তাই তো না বলে পারছি না, অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে তার চেহারার বৈশিষ্ট্যটুকুই প্রাধান্য পেত। মোদ্দা কথা, তার চেহারার বৈশিষ্ট্যটুকুই আমাকে বিভ্রান্তির মুখে সবচেয়ে বেশি করে ঠেলে দেয়। এবার দু-চার কথায় তার চেহারার বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করা যাক। মি. বেডলোর শরীরটা ছিল রোগাটে, একেবারেই লিকলিকে। আর তিনি লম্বাও কম ছিলেন না। সংক্ষেপে বললে, তিনি ছিলেন ইয়া লম্বা এক রোগাটে চেহারার মানুষ। আর পথ চলার সময় সামনের দিকে একটু বেশি রকমই ঝুঁকে চলতেন। অস্বাভাবিক লম্বা আর পাটকাঠির মতো লিকলিকে। হাড়ের ওপর মাংসের লেশমাত্রও ছিল বলে মনে হত না। আর কপালটা ছিল একটু বেশি রকমই চওড়া ওনিচু। তাঁর মুখটা ছিল চওড়া আর দুপাশে হাড় বের করা। আর নমনীয়ও ছিল বটে। মুখের দিকে অনুসন্ধিৎসু নজরে তাকালে সেখানে ছিটেফোঁটা রক্ত ছিল বলেও মনে হত না। তাঁর মুখের আর যে একটা বিশেষত্ব খুব বেশি করে নজরে পড়ত তা হচ্ছে, অসমান দাঁতের পাটি। এমন এলোমেলো এবড়ো খেবড়ো দাঁতের পাটি ইতিপূর্বে অন্য । কারো মুখে আমার অন্তত চোখে পড়েনি।