তার মনোবল ছিল বাস্তবিকই সুদৃঢ়। অন্তরে অফুরন্ত উচ্চাশা পোষণ করত, নিজের ওপর আস্থাও ছিল যথেষ্টই আর দুঃসময়কে কিভাবে সুসময়ে পরিণত করা যায়। সে ফন্দিও অবশ্যই তার জানা ছিল।
১৮১২ খ্রিস্টাব্দে অ্যাসটোরিয়া নামক একটা অভিযানের বই ছাপা হয়ে বাজারে ছাড়া হয়। এর পাতায় পাতায় জন জ্যাকবের দুৎসাহসিক অভিযানের টুকরো টুকরো শ্বাসরোধকারী বিবরণ ছাপা হয়েছে। যারা পড়তে ও জানতে আগ্রহি তাদের জন্যই এ কথা বলা।
ইম্প অফ দ্য পারভাস
মানুষের বিবেগটা মাঝে মধ্যে নরবড়ে হয়ে যায়–যার ফলে তারা কুকর্মে লিপ্ত হয়। তার কাজকর্ম দেখে আমরা তখন বলাবলি করি, লোকটা মানসিক বিকৃতির শিকার হয়ে পড়েছে।
আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, শয়তান তার মধ্যে ভর করে তাকে কুকর্মে লিপ্ত করে। কোন কোন সময় এমনও দেখা যায়, অত্যাশ্চর্য ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার ফলে তার ভালোই হয়েছে। কাণ্ডটা না ঘটানো পর্যন্ত তার ছোঁকছোঁকানি ভাবটা তাকে যে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত এখন তার কবল থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়েছে।
এবার আমার প্রসঙ্গে আসা যাক।
বহুদিন ধরেই খুন করার পরিকল্পনাটা আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু ইচ্ছা থাকলে সাহসে ভর করে মতলবটাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারছিলাম না। একটা আতঙ্ক বুকের ভেতরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই ধুকপুকানি শুরু হয়ে যেত গোয়েন্দারা যদি পাকড়াও করে ফেলে? বুকের ভেতরে জাঁকিয়ে বসে-থাকা এ আতঙ্কটার জন্যই আমি খুনটা করতে পারছিলাম না, গড়িমসি করছিলাম।
তারপর একদিন একটা ফরাসি বই হাতে পেলাম। সেটাকে গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম। তাতে লেখা হয়েছে, অদ্ভুত কৌশল অবলম্বন করে এক মহিলাকে খুন করা হয়েছে। কৌশলটা আমার খুবই মনে ধরে গেল। অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে বইটার আগাগোড়া আবারও পড়ে ফেললাম।
পরিকল্পনা যে শুধুমাত্র অত্যুড়ুত তা-ই নয়। রীতিমত মৌলিকও বটে।
বইটায় উল্লেখিত পরিকল্পনা হচ্ছে–মোমবাতির সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মোমবাতিটা জ্বলার সময় তা থেকে বিষাক্ত গ্যাস ঘরময় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সে বিষাক্ত গ্যাস নাকের মাধ্যমে তার ফুসফুসে ঢোকে। মহিলাটি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তারপর তিনি পুঁকতে ধুঁকতে এক সময় পটল তোলেন। ব্যস, কাজ হাসিল। চমৎকার! অত্যাধুনিক এক মৌলিক পরিকল্পনার মাধ্যমে খুন।
ব্যস, আর মুহূর্তমাত্রও দেরি না করে আমি পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে এ-বেড়ে মতলবটাকে কাজে লাগিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করব না।
যে লোকটাকে খুন করার জন্য আমি মানসিক অস্থিরতা বোধ করেছিলাম, রীতিমত ছোঁকছোঁক করে বেড়াচ্ছিলাম, তার অনেকগুলো বাতিক ছিল, বদঅভ্যাসও বলা চলে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, বিছানায় শুয়ে অনেক রাত অবধি বই পড়ায় মেতে থাকা। তখন ভেতর থেকে জানালা-দরজা বন্ধ করে ঘরটাকে সে একটা পায়রার খোপে পরিণত কওে নিত। আমার মতলবটাকে বাস্তবরূপ দেওয়ার মতো মোক্ষম পরিবেশই বটে।
ব্যস, আমি কোমর বেঁধে কাজে লেগে গেলাম।
বিষ মিশিয়ে একটা জব্বর মোমবাতি তৈরি করে ফেললাম। এবার নিজেহাতে তৈরি মোমবাতিগুলোর একটা তার ঘরে দিলাম জ্বালিয়ে।
পরদিন সকালে দেখলাম, নচ্ছাড়টা বিছানায় মরে শক্ত হয়ে এলিয়ে পড়ে রয়েছে।
ডাক্তার ডেকে আনা হলো। তিনি লিখলেন–ঈশ্বর সন্দর্শনে তার মৃত্যু হয়েছে।
আমার বাঞ্ছা পূরণ হলো। পথের কাঁটা নির্বিবাদেই দূর হয়ে গেছে। ব্যস, আমি তার বিষয় আশয়ের মালিক বনে গেলাম।
অগাধ অর্থ বাগিয়ে নিয়ে মৌজ করে সেগুলোর সদ্বব্যবহার করে কয়েকদিন আনন্দে কাটিয়ে দিলাম।
গোয়েন্দারা যতই আশপাশ দিয়ে ছোঁকছোঁক করে বেড়াক না কেন, আমার একটা চুলও স্পর্শ করতে পারবে না। আমি নিঃসন্দেহ, আর এসব বাজে ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে সময় কাটানোর দরকারও মনে করি না।
নচ্ছার বুড়োর ঘরের মোমবাতির শেষাংশটুকু আমি গায়েব করে দিয়েছিলাম। সন্দেহ করার মতো তিলমাত্র চিহ্নও কোথাও রাখিনি।
অপরাধ? হ্যাঁ অপরাধ তো আমি অবশ্যই করেছি। কিন্তু অনেক ভেবে চিন্তে চারদিক বজায় রেখে তবেই কাজটা করেছি। ফেঁসে যাওয়ার মতো সামান্যতম সূত্রও কোথাও রাখিনি। অতএব আমার গায়ে হাত দেওয়ার হিম্ম কার আছে? কে আমাকে পাকড়াও করবে? তাই আমি রীতিমত পুলকানন্দেই মেতে ছিলাম।
আমি নিজের নিশ্চিদ্র ও নিশ্চিত নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে প্রতিটা দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা মুহূর্ত নিরাপত্তার ভাবনায় ডুবে থাকতাম।
হ্যাঁ, খুন আমি করেছি। আমি খুনি। কিন্তু খুন করেও আমি গোয়েন্দাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমি সর্বদা এসব ভাবনায় ডুবে থাকতাম আর অভাবনীয় এক পুলকানন্দে ফেটে পড়ার যোগাড় হতাম। খুন করেও আনন্দ উল্লাসের জোয়ারে নিশ্চিন্তে গা ভাসিয়ে চলা–কম কথা!
একদিন রাস্তা দিয়ে একা একা হাঁটার সময় আপন মনে সে ঘটনাটার কথা ভাবছিলাম। আমি স্বগতোক্তি করলাম–আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ। আমি গোয়েন্দাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমার ওপর কারো তিলমাত্র সন্দেহও নেই, থাকার কথাও নয়।
মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে আবারও স্বগতোক্তি করতে লাগলাম–আরে ধ্যুৎ! কে আমার গায়ে হাত দেবে। আমার গায়ে কাঁটার আঁচড় দেওয়ার সাধ্যও কারো নেই। আমিনিজে থেকে যদি স্বীকার না করি তবে আমার গায়ে হাত দেয় কার সাধ্য!