অবাক না হয়ে পারলাম না, তার মুখের কোথাও এমন কোনো একটা রেখা নেই যা আমার মুখে অনুপস্থিত। অর্থাৎ হুবহু আমারই মুখের মতো। আমারই মুখটা যেন তার কাঁধের ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুটো মুখই যেন একই ছাঁচে গড়া।
কেবলমাত্র মুখের কথাই বা বলি কেন? তার পোষাক-আশাকে এমন একটা সূতোও নেই যা আমার পোশাকে নেই। আর পোশাক তৈরির কায়দা-কৌশলও অবিকল একই রকম। যেন একই কাপড় আর একই দর্জি দিয়ে উভয়ের পোশাকই তৈরি করানো হয়েছে।
হ্যাঁ, স্বীকার না করে উপায় নেই। সত্যি বলছি, সে অন্য কেউ নয়, অন্য কিছুই নয়, উইলসনই বটে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও সে কিন্তু অনুচ্চ কণ্ঠে, ফাঁসাসে কণ্ঠস্বরে কথা বলল না। তার কণ্ঠস্বর শুনে আমি অনায়াসেই ধরেনিতে পারতাম যে, কথাগুলো সে নয়, আমিই বলে চলেছি।
সে বলে চলল, হেরে গেছি, আমি হেরে গেছি, আমি হেরে গেছি। তুমিই জয়ী হয়েছ। তবু আজ, এ-মুহূর্ত থেকে তুমিও মৃত–পৃথিবীবাসীর কাছে, পরম পিতার কাছে, আর আমার কাছে তুমিও মৃত।
তুমি এতকাল আমারই মধ্যে বেঁচেছিলে। আর আজ, এ-মুহূর্তে আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ-মূর্তি যা তোমার মতো নয়–তোমারই মূর্তি তার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই আমার কথার সত্যতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারবে, চূড়ান্তভাবে আমাকে নয়, তুমি নিজেকেই হত্যা করেছ। হত্যা! আত্মহত্যা করেছ তুমি।
এ টেল অব জেরুজালেম
৩৯৪১ বিশ্বাব্দ!
সে বছরেরই তামুজা মাসের দশ তারিখে আবেশ ফিস্তি বুজি-বেন-লেভি আর ফ্যারিসীয় সাইমিয়নকে বলল–চল, আমরা যতশীঘ্র সম্ভব এখান থেকে কেটে পড়ি।
চোখে-মুখে জিজ্ঞাসার ছাপ এঁকে বুজি-বেন-লেভি আর ফ্যারিসীয় সাইমিয়ন সমস্বরে বলে উঠল– কোথায়? কোথায় কেটে পড়তে চাইছ?
বৈনামিন সদর দরজার গায়ের দুর্গপ্রাকারে। সেখানে ডেভিড শাসনাধীন। আর সেখান থেকে কায়েরদের শিবির অদূরে দেখাও যায়। এটাই সূর্যোদয়ের মুহূর্ত–চতুর্থ প্রহরের শেষ ঘণ্ট। পৌত্তলিকরা পম্পের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে অবশ্যই আমাদের জন্য কুরবানির ভেড়া নিয়ে অধীর অপেক্ষায় প্রতিটা প্রহর কাটাচ্ছে।
বুজি-বেন-লেভি, সাইমিয়ান, আবেশ আর ফিস্তিম তিনজনই সুপবিত্র শহর জেরুজালেমের কুরবানির উপ-সংগ্রহে নিযুক্ত।
এবার ফ্যারিসীয় বলল–আর এক মুহূর্তও দেরি করা মোটেই সমিচিন নয় বলেই আমি মনে করছি। চল, যতশীঘ্র সম্ভব এ জায়গা ছেড়ে চল। কারণ, উদারচেতা নয় বলে এ-পৌত্তলিকদের অখ্যাতি রয়েছে।
হুম্! বুজি-বেন-লেভি প্রায় অক্ষু স্বরে উচ্চারণ করল।
ফ্যারিসীয় বলে চলল–আর জানোই তো বাস-পূজারীদের পক্ষে তো চপল মতিত্ব অবশ্যই বিশেষ একটা গুণ বলে গণ্য হয়।
তারা চপলমতিই কেবল নয়, বিশ্বাসঘাতকও বটে।
তবে?
তবে তারা কেবলমাত্র এডোনাইয়ের লোকদের ব্যাপারেই তারা বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়ে থকে। এমোনটারা সেনিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে সদা সতর্ক নয় এমন কথা কে, কবে শুনেছে বলতে পার?
বটে!
আমার কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের হাতে গোটা কয়েক ভেড়া আল্লাতাল্লার বেদির জন্য তুলে দিয়ে আর প্রতিটা মাথার বিনিময়ে ত্রিশ সেকেল রোজগার করে। নেওয়াটাকে উদার মনোভাবের পরিচায়ক বলে মনে করা যেতে পারে কি?
বেন লেভি, তোমার কিন্তু ভুল হচ্ছে, মানে তুমি ভুলে যাচ্ছ এভাবে আল্লাতালার বেদির জন্য খরিদ করা ভেড়াগুলোকে আমাদের পেটের জ্বালা নেভানোর কাজে ব্যবহার করব না, তার কোনো নিশ্চয়তা কিন্তু আমাদের দিক থেকে রোমক পস্পেকে দেওয়া হয়নি, ঠিক কি না?
হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিকই।
এবার ফ্যারিসীয় গলাছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল–আমার কথা শোন, মোল্লা হিসেবে যে আমার পক্ষে দাড়ি-গোঁফ কামানো নিষিদ্ধ তার পাঁচটা কোন্টের দোহাই।
একটু নীরবতার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে সে আবার বলল–তবে কি আমরা সে বিশেষ দিনটার অপেক্ষায়ই বেঁচে রয়েছি, রোমের এক পাপাত্মা নরাধম, পৌত্তলিক বাদশা যেদিন হঠাৎই আমাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করে বসবে যে, সে সব পবিত্র বস্তুকে আমরানিজেদের দেহের ক্ষিদে, পেটের জ্বালা নেভানোর জন্য আত্মসাৎ করব? সেদিনটার অপেক্ষাই কি আমরা পৃথিবীতে টিকে রয়েছি, যেদিন
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আবেশ কিস্তিম বলে উঠল-থাক, আর বলতে হবে না, বুঝতে পেরেছি। আমার কথা শোন, আমরা ফিলিস্তিমির অভিপ্রায়ের ব্যাপারে একটাও প্রশ্ন করব না, কোনো প্রশ্নই না।
সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু কারণটা জানতে পারি কী?
হ্যাঁ, কারণ তো অবশ্যই কিছু না কিছু আছে।
কী সে কারণ?
কারণটা হচ্ছে, আমরা তার লিলা বা উদারতার দ্বারা আজই প্রথম লাভবান হচ্ছি না।
বুঝলাম।
যাক, পা চালাও। আমরা দ্রুত পা চালিয়ে হেঁটে যত শীঘ্র সম্ভব মসজিদের কাছে পৌঁছে যাই। যাতে সে মসজিদটার জন্য প্রয়োজনীয় ভোজ্যদ্রব্যের অভাব না ঘটে। যার জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ থেকে বৃষ্টি দিয়ে নেভানোর ক্ষমতা রাখে না। কোনো ঝড় ঝাঁপটা যার ধোঁয়ার কুণ্ডলিকে স্থানচ্যুত করে দিতে পারে না।
নগরের যেখানে আমাদের উপযুক্ত গিকারিমটা গিয়ে দাঁড়াল, সে স্থানটার সঙ্গে দোণ্ড প্রতাপশালী স্থাপিত রাজা ডেভিডের নাম জড়িত রয়েছে, তাকেই জেরুজালেমের সবচেয়ে সুরক্ষিত ও নিরাপদ অঞ্চল মনে করা হয়।