ঠিক সে মুহূর্তে ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন আচমকা আমার কাঁধে হাত রাখল। ঘাড় ফিরিয়ে হাতের মালিককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করার আগেই আমার কানে এলো সে চিরস্মরণীয়, ফ্যাসফ্যাসে, ক্ষীণ অভিশপ্ত কণ্ঠস্বরটা।
আমি মুহূর্তে যেন রেগে একেবারে আগুন হয়ে গেলাম। ক্রোধে আমার সর্বাঙ্গ থর থরিয়ে কাঁপতে লাগল আর মাথায় রক্ত উঠে যাওয়ার যোগাড় হলো। আমি গর্জে উঠলাম–‘শয়তান। হতচ্ছাড়া! নচ্ছাড় কাহাকার। না, কিছুতেই না। এভাবে মৃত্যু পর্যন্ত তোমাকে আমি আঠার মতো আমার সঙ্গে সেঁটে থাকতে দিচ্ছি না, কিছুতেই না।’
সেনির্বাক। টু-শব্দটিও করল না।
আমি আগের মতোই তর্জন গর্জন করতে লাগলাম–‘শয়তান, আমার সঙ্গে এসো। আসতেই হবে তোমাকে। তা যদি না কর তবে যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেখানেই ছুরির ফলাটা তোমার বুকে আমুল গেঁথে দেব, বলে দিচ্ছি!’
আমার মেজাজ মর্জি তখন এমনিতেই খুবই বিগড়ে ছিল। আমার বাঞ্ছিতা রূপসি যুবতিকে কাছে পাবার জন্য ব্যর্থ হয়ে পড়েছিলাম। ফলে আমার কাঁধে তার হাতটা পড়ামাত্র দুম্ করে সেটাকে চেপে ধরে ফেলেছিলাম।
হ্যাঁ, আমার অনুমান অভ্রান্তই বটে। অবিকল আমার মতোই পোশাক সে গায়ে চাপিয়েছিল। একটা স্পেনি আলখাল্লা। প্রায় পায়ের পাতা পর্যন্ত ঝুলে পড়েছিল। নীল ভেলভেটের তৈরি। লাল বেল্টের সঙ্গে সুতীক্ষ তরবারিটা ঝুলছিল। আর কালো রেশমি মুখোশ দিয়ে মুখটাকে ঢেকে রাখা ছিল। ফলে তার মুখের সামান্যতম অংশও নজরে পড়ছিল না। তবে শয়তানটাকে চিনতে আমার অসুবিধা হয়নি।
আমি আবার গর্জে উঠলাম–‘এসো আমার সঙ্গে।
আবারও বলছি কোনোরকম ধান্ধাবাজির চেষ্টা করলে চোখের পলকে তোমার বুকে ছুরির ফলাটা গেঁথে দেব, শুনে রাখ!’
আমি কথা বলতে বলতে তার কলারটা শক্ত করে চেপে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে তাকে নাচের আসর থেকে পাশের ছোট ঘরটায় নিয়ে গেলাম। আশ্চর্য ব্যাপার! সে কিন্তু বাধা দেওয়ার চেস্টা করা তো দূরের ব্যাপার কোনোরকম আপত্তি পর্যন্ত করল না। বরং নিতান্ত অনুগতের মতোই আমার সঙ্গে সে ঘরটায় ঢুকল।
আমি তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই সজোরে একটা ধাক্কা দিলাম। সেনিজেকে সামলাতে না পেরে টলতে টলতে সামনের দেওয়ালটায় দুম করে আছড়ে পড়ল।
আমি ব্যস্ত হাতে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। প্রায় গর্জে উঠেই বললাম–‘খাপ থেকে আমার তরবারিটা বের কর।’
মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে সে চাপা নিশ্বাস ফেলল। তারপর নীরবে খাপ থেকে তরবারিটা বের করে হাতে নিল।
আমি হুঙ্কার ছাড়তেই সে আত্মরক্ষার জন্য তরবারিটা শক্ত করে ধরে তৈরি হয়ে নিল।
আমাদের উভয়ের মধ্যে লড়াই হলো। তবে খুবই অল্পসময়ের লড়াই। মনে করা যেতে পারে, লড়াই ভালোভাবে শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেল।
আমার মধ্যে তখন চরম উত্তেজনা ভর করেছে। উত্তেজনায় প্রায় উন্মদদশা প্রাপ্ত হয়েছি। আমার একটা হাতে যেন হাজার হাতের শক্তি এসে ভর করেছে। অসুরের শক্তি অনুভব করলাম।
লড়াই শুরু হবার মাত্র সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই একমাত্র দৈহিক শক্তির ওপর নির্ভর করে দেওয়ালের কাঠের আবরণটার সঙ্গে সজোরে চেপে ধরলাম। তার নড়াচড়া করার মতো সামান্যতম শক্তিও রইল না। আমার মধ্যে তখন নেকড়েরনিংস্রতা ভর করেছে। আমার চরমতম শত্রুটাকে পেয়ে নেকড়ের মতো হিংস্রতায় আমার হাতে ঝকঝকে চকচকে তীক্ষ্ম তরবারির ফলাটাকে বার বার তার বুকে গেঁথে দিতে লাগলাম।
ঠিক সে মুহূর্তেই মনে হলো কে যেন দরজায় অনবরত ধাক্কা মারছে, খোলার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
দরজাটা খুলে কেউ যদি ঘরে ঢুকে আসে, ব্যাপারটা জানা জানি হয়ে যায়, তাই দৌড়ে গিয়ে সিটকিনিটাকে ভালোভাবে আটকে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আবার এক লাফে আমার চরমতম শত্রুর কাছে ফিরে গেলাম।
কিন্তু হায়! যে অভাবনীয় দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, তার ফলে আমার মধ্যে যে বিস্ময়ের সঞ্চার হলো, যে আতঙ্ক আমার বুকে চেপে বসল, আমাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলল তাকে আমি কোন ভাষায় ব্যাখ্যা করব। সে যে নিছকই বর্ণনাতীত ব্যাপার।
মুহূর্তের জন্য আমি চোখ ফিরিয়ে ছিলাম, সেটুকু সময়ের মধ্যেই ঘরের সব ব্যবস্থা রীতিমত বদলে গেছে। যাকে বলে ঘরের সবকিছুরই আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। কয়েক মুহূর্ত আগে যেখানে কিছুই আমার নজরে পড়েনি এখন সেখানে আমার দৃষ্টি গেল। অন্তত সে মুহূর্তে আমার এরকমই মনে হয়েছিল। দেখলাম বিশাল একটা আয়না।
আমি চরম আতঙ্ক বুকে নিয়ে দুপা এগিয়ে গিয়ে যখন আয়নাটার মুখোমুখি দাঁড়ালাম, তখন একেবারেই অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার প্রত্যক্ষ করলাম। মনে হলো আমার নিজের মূর্তিই আঁকাবাঁকা গতিতে আমার মুখোমুখি হবার জন্য এগিয়ে এসেছে। তবে সে মূর্তি তখন চকের মতো ফ্যাকাশে, বিবর্ণ আর রক্তাপ্লুত। ভয়ঙ্কর একটা মূর্তি যেন একেবারে আমার মুখোমুখি স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এরকম দেখলাম, বলছি ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আদৌ তা নয়। মৃত্যুযন্ত্রণা আর হতাশা হাহাকারে জর্জরিত হয়ে যে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল, সে উইলসনই বটে। নিজের গায়ের আলখাল্লা আর মুখোশটাকে সে খুলে যে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিল সে দুটো তেমনি সেখানেই পড়ে থাকতে দেখলাম।