অক্সফোর্ড ছেড়ে পালিয়ে এসে ভাবলাম, বুঝি অব্যাহতি পেয়ে গেলাম। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, বৃথাই পালিয়ে এসেছি।
আমার অশুভ ভাগ্য বুঝি অধিকতর উল্লাসে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে ব্যস্ত। একটা কথাই বুঝি আমাকে বিশেষ করে বুঝিয়ে দিতে চাইছে, এখানেই শেষ নয়, বরং আমার পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো সবে তো শুরু হয়েছে।
অক্সফোর্ড ছেড়ে এসে আমি এবার প্যারিস নগরীতে মাথা গুঁজলাম।
প্যারিসে হাজির হওয়া মাত্রই আমার সম্বন্ধে উইলিয়াম উইলসনের মধ্যে যে অবাঞ্ছিত আগ্রহ ভর করেছে তার প্রমাণ হাতে-নাতে পেয়ে গেলাম। একের পর এক বছর পেরিয়ে গেল তবু কিন্তু আমার দুঃখ-যন্ত্রণা ঘুচল না।
হতচ্ছাড়া শয়তান! আমি রোমে অবস্থানকালে কত অসময়ে, কী এক ভৌতিক পরিবেশে সে যে কতবার আবার আমার উচ্চাকাঙ্খর মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে আমাকে বিপর্যস্ত করেছে, যারপরনাই হেনস্তা করেছে, সে-সব কথা ভাবতে গেলে আজও আমার। গায়ে রীতিমত কাঁটা দিয়ে ওঠে, শরীর শিথিল হয়ে আসতে থাকে।
কেবলমাত্র রোমের কথাই বা বলি কেন? ভিয়েনাতেও সে আমাকে কম উত্যক্ত করেনি। তারপর বার্লিন আর মস্কোতেও শয়তানটা আমার পিছন ছাড়েনি। যাকে বলে, সে আমার সঙ্গে যেন আঠালির মতো লেগেছিল। এক জায়গার কথা বলা যাবে না, যেখান থেকে আমার অন্তরের বিতৃষ্ণা নিঙড়ে তাকে অভিসম্পাত দেবার মতো যথেষ্ট কারণ ছিল না।
অতিষ্ট! আমি তার দুর্বোধ্য অত্যাচারে রীতিমত অতিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। উপায়ান্তর না দেখে আমি তার জঘন্য অত্যাচারের হাত থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষ যেভাবে মহামারীর কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য উন্মাদের মতো পালায়, আমিও ঠিক তেমনই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পৃথিবীর শেষপ্রান্তে পালিয়ে যাই। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। পালিয়ে গেলাম বটে, কিন্তু ফায়দা কিছুই হলো না! শয়তানটা একটা দিনের জন্যও আমার সংস্রব থেকে দূরে থাকেনি। অতএব দুর্বিষহ যন্ত্রণা আমার সর্বক্ষণের সঙ্গি হয়ে দাঁড়াল।
দিনের পর দিন, বছরের পর বছর দুর্বেধ্য অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে আমি বার বার নিজের মনকেই প্রশ্ন করেছি–কে? সে কে? কোথা থেকেই বা আমাকে উত্যক্ত করতে ছুটে আসে? তার উদ্দেশ্য কি? কোন্ প্রত্যাশায়ই বা আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে চলেছে? আ িদিনের পর দিন নিজেকে এমন সব প্রশ্ন করেছি। কিন্তু হায়! কোনো জবাবই পাইনি। তবে এও সত্য যে, একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি, শয়তানটা যেখানে, যতবারই আমার সামনে আবির্ভূত হয়েছে, আমার ইচ্ছায় যখনই সে নাক গলিয়েছে, নানাভাবে বাধা দিয়েছে–কোনো বারই আমার পক্ষে তার মুখটা দেখা সম্ভব হয়নি, কিছুতেই না।
উইলিয়াম উইলসন নামধারী লোকটা যেই হোক, যেখান থেকেই এসে আমার সামনে হাজির হোক না কেন, সে কি একটা মুহূর্তের জন্যও মনে স্থান দিয়েছে, ইটন শহরে যে আমাকে বিশ্রিভাবে তিরস্কারের মাধ্যমে উত্যক্ত করেছিল, আমি অক্সফোর্ডে অবস্থানকালে সে আমার অপমানের চূড়ান্ত করে সম্মানকে ধুলিসাৎ করে দিয়েছিল, রোমে সে প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে আমার উচ্চাকাঙ্খকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল, প্যারিসে আমার প্রতিহিংসাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল আর আমার অত্যুগ্র ভালোবাসাকে ব্যর্থ করে দিয়ে মন-প্রাণ হতাশা আর হাহাকারে ভরিয়ে তুলেছিল– যে লোকটা আমার সবচেয়ে বড় চিরশত্রু, আমার অশুভ অদৃষ্ট, আমি কিন্তু তার মধ্যে আমার স্কুলের সহপাঠী, আমার নামের সঙ্গে যার হুবহু মিল ছিল, সে জঘন্য ঘৃণিত ভয়াবহ প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখতে পাইনি, অবশ্যই নয়।
অসম্ভব! একেবারেই অসম্ভব! এ শয়তানটা কিছুতেই অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ড. ব্রানসবির স্কুলে আমার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী উইলিয়াম উইলসন হতে পারে না।
যাক আর নয়, অকল্পনীয় সে ব্যাপারটা নিয়ে অনেক কথাই তো বলেছি। সত্যি কথা বলতে কি, শয়তানটার ন্যাক্কারজনক কাজের পুরো ফিরিস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এ নাটকের শেষ ঘটনাবহুল দৃশ্যের অবতারণা করাই শ্রেয়।
আঠারো খ্রিস্টাব্দের কথা।
আমি তখন রোমে বাস করছি। সে বছরের উৎসবে আমি উপস্থিত ছিলাম। নেপলসের ডিউক ডি ব্ৰগলিওর পালাজ্জোতে এক মনোজ্ঞ মুখোশ-নৃত্যের অনুষ্ঠান হয়েছিল। সে নৃত্যানুষ্ঠানে আমি দর্শকের আসনে ছিলাম।
আমি ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে মদের টেবিলে বসে মদ গিলতে গিলতে মুখোশ নৃত্যের অনুষ্ঠান দেখছিলাম। আর খুব বেশি রকম হৈ-হুঁল্লোড়ে মেতে গিয়েছিলাম, অস্বীকার করা যাবে না।
ঘরটায় তখন গাদাগাদি ভিড়। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আর সে সঙ্গে অসহ্য গরমও ছিল। আবহাওয়া নিতান্তই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। আমি আর এক মুহূর্তও টিকতে না পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। এবার অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে জবুথুবু হয়ে পড়া বুড়ো ডি ব্ৰগলিওর রূপসি যুবতি স্ত্রীর খোঁজে ভিড়ের ভেতরে দাপাদাপি শুরু করে দিলাম।
সে রূপসি যুবতি তার পোশাকের গোপন কথাটা আমাকে আগে থেকেই বলে দিয়েছিল। অতএব আমার মধ্যে তাকে খুঁজে বের করার আগ্রহটা যে আরও অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছিল, অস্বীকার করব না।
আমি ভিড়ের মধ্যে তাকে হন্যে হয়ে খোঁজা শুরু করে দিলাম। শেষপর্যন্ত ভিড়ের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য তাকে দেখতে পেলাম। ব্যস, আমি উদ্রান্তের মতো একে ওকে ধাক্কা দিয়ে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।