ফ্যাসফ্যাসে স্বরে সে বলতে আরম্ভ করল–উপস্থিত ভদ্র মহোদয়গণ, আমার এ আচরণের জন্য আমি অবশ্যই দুঃখিত নই। অতএব মার্জনা ভিক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ? কারণ একটাই, আজ আমি কেবলমাত্র কর্তব্য পালন করছি। ব্যস, এর। বেশি কিছু অবশ্যই নয়।
এরকম কথা আমি কেন বলছি আপনাদের জানতে ইচ্ছে করছে, তাই না? বলব, সবই বলব। ধৈর্য ধরে শুনুন, সবই খোলসা করে বলছি–যে লোকটা আজ রাতে জুয়া খেলায় হারিয়ে দিয়ে লর্ড গ্লোন্ডিনিং-এর কাছ থেকে প্রচুর অর্থ জিতে নিয়েছে তার চরিত্র, মানে আসল পরিচয় আপনাদের জানা নেই। আর জানার কথাও নয়।
আমি এখন আপনাদের কাছে জানতে চাই, তার আসল পরিচয় জানার জন্য আপনাদের মনে কৌতূহল জাগছে না? আমি তো মনে করছি, তা জানার জন্য আপনারা অবশ্যই অত্যুৎসাহি। শুনুন তবে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা জানার পথ আমি আপনাদের বলে দিচ্ছি। এখন কি বলছি, সবই মন দিয়ে শুনুন–‘অনুগ্রহ করে সময় সুযোগ মতো তার জামার বাঁ-হাতের আস্তিনের ভেতরের দিকটা আর তার নকসা-করা চাদরটার ভেতর দিককার বড় বড় পকেটগুলো তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করবেন, বুঝলেন?
সবাই নির্বাক। ঘরের ভেতরে গভীর নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল।
এদিকে কথাগুলো বলেই আগন্তুক মূর্তিটা যেমন দ্রুতগতিতে ঘরটায় ঢুকেছিল, ঠিক তেমনি দ্রুত চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে চলে গেল। মুহূর্তে কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেল।
আমার তখনকার মানসিক অবস্থার বর্ণনা কীই বা দেব? দেওয়া সম্ভব হবে কি? আমার কি না বললেই নয় যে, অভিশপ্ত এক জীবনের নিরবচ্ছিন্ন হাহাকার আর হা হুতাশে আমার বুকটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল?
না, কোনোকিছু ভাববার মতো অবসর আমর নেই, মোটেই নেই। অনেকগুলো হাত একই সঙ্গে এগিয়ে এলো। সেখানেই আমাকে সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরল।
ঘরের ভেতরে আবার মোমবাতি জ্বলে উঠল। আগের মতোই আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল। মুহূর্তমাত্রও দেরি না করে জোর তল্লাসি শুরু করে দেওয়া হল।
ছায়ামূর্তিটার কথাগুলো উপস্থিত সবার মনেই দাগ কেটে দিয়ে গেছে। তার পরামর্শমাফিক সবাই আমার জামার আস্তিন আর গায়ে নকশা-করা চাদরটার ভেতরের দিকটা পরীক্ষা করার কাজে মেতে গেল। আস্তিনের লাইনিংটা ঘাটাঘাটি করতেই তার ভেতর থেকে, চাদরের ভেতরের পকেটগুলো থেকে জুয়াখেলার জাল জুয়াচুরির সব কটা নকল তাস নানারকম মার্কা-দেওয়া তাস দমাদম মেঝেতে পড়তে আরম্ভ করল। আমার ধাপ্পাবাজির কারসাজি সবই ফাঁস হয়ে গেল।
তারপরই ঘরটার মালিক বন্ধুটা মেঝে থেকে, পায়ের তলা থেকে একটা দুপ্রাপ্য ও বহুমূল্য পশমের আলখাল্লা তুলে নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল–‘মি. উইলসন, এটা আপনার নিন, ধরুন।
আমি হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে দেখলাম, আমার আলখাল্লাটাই বটে। নিজের ঘর ছেড়ে আসার সময় চাদরের ওপর সেটাকে চাপিয়ে এসেছিলাম। শীত খুব আঁকিয়ে পড়েছিল। তাই সেটাকে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখানে এসে সেটাকে খুলে জানালার সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম।
ঘরের মালিক-বন্ধুটা আবার সরব হল- মি. উইলসন, নিঃসন্দেহ হচ্ছি, জুয়াখেলার হাত সাফাইয়ের আরও প্রমাণ খুঁজে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। আমাদের প্রয়োজনীয় সে প্রমাণ তো অনেকেই ইতিমধ্যেই আমরা হাতে পেয়ে গেছি। আমি কি বলব ভেবে না পেয়ে অন্যমনষ্কভাবে আলখাল্লাটার ধুলো ঝাড়াঝাড়ি করে নিজেকে ব্যস্ত রাখলাম।
ঘরের মালিক-বন্ধুটা এবার একটু বেশ কড়া মেজাজেই বলল–‘আমি আশা করছি, আপনি আজই অক্সফোর্ড থেকে বিদায় নেবেন। আর এও আশা করছি, কথাটা আর দ্বিতীয়বার বলতে হবে না।
আমি নিতান্ত অপরাধীর দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সে এবার বলল–আরও আছে, এ মুহূর্তেই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে বাধিত হব।’
তখন আমি কী লজ্জায় পড়লাম, অপদস্থ হলাম তা আর বলার নয়। সে মুহূর্তে আমি এমনই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম যে, নিজেকে সামলে-সুমলে না রাখতে পারলে হয়তো বা তার পিঠে কয়েক-ঘা বসিয়েই দিতাম। আর ঠিক সে মুহূর্তে আর একটা বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটে গিয়েছিল, যার ফলে আমার মনোযোগ সেদিকেই অস্পষ্ট হয়ে পড়েছিল। ঘরের মালিক-বন্ধুর আজ্ঞা পাওয়ার এটাও একটা বড় কারণ বটে।
বিস্ময়কর ঘটনাটা হচ্ছে, ঘরের মালিক মি. প্রেস্টন যখন মেঝে থেকে আলখাল্লাটা আমার হাতে তুলে দিল তখন আমি খেয়ালই করিনি যে, আমার নিজের আলখাল্লাটা আমারই অন্য হাতে ধরা রয়েছে। আর যে আলখাল্লাটা সে আমার হাতে তুলে দিল সেটা অবিকল আমার আলখাল্লাটারই মতো।
এবার ব্যাপারটা আমার মনে পড়ে গেল, যে বিশেষ লোকটা অকস্মাৎ উপস্থিত হয়ে আমার নিষ্ঠুরভাবে জারিজুরি ফাঁস করে, মুখোশটা মুহূর্তের মধ্যে খুলে দিয়ে উল্কার বেগে চম্পট দিল, তার গায়েও একটা আলখাল্লা দেখেছিলাম। সে আর আমি ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তির গায়েই আলখাল্লা ছিল না।
যাক, যে কথা বলতে যাচ্ছি, ঘরটার মালিক-বন্ধু মি. প্রেস্টনের দেওয়া আলখাল্লাটা আমার নিজের আলখাল্লাটার ওপর চাপিয়ে নিয়ে বীরদর্পে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। চরম নির্দেশ পাওয়ার পর আর সেখানে থাকাও তো সম্ভব ছিল না।
আমার প্রতি পরবর্তী নির্দেশ, আমাকে অক্সফোর্ড ছেড়ে চলে আসতে হবে। অনন্যোপায় হয়েই পরদিন কাকডাকা ভোরে, দিনের আলো ফোঁটার আগেই ভয় ও লজ্জায় অক্সফোর্ড ছেড়ে মহাদেশের উদ্দেশে পা-বাড়াতেই হল।