একটা বের করতেই হবে।
মদের নেশায় জড়িয়ে-আসা গলায় গ্লোন্ডিনিং বলে উঠল–কোনো সমস্য নেই দোস্ত! খেলা চলবেই।
আমি ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে তুলে বললাম–সে না হয় বুঝলাম, খেলা চলবে। কিন্তু বন্ধু তোমার পকেটে যে একটা কানাকড়িও নেই। তবে খেলাটা চলবে কি করে দয়া করে বলবে কী?
‘তুমি আমাকে কিছু মালকড়ি ধার দাও। সময়মত শুধরে দেব, কথা দিচ্ছি।’
‘হ্যাঁ, এটা অবশ্য সম্ভব হতে পারে। কথা বলতে বলতে তার পকেট থেকে আমার চলে আসা একটা নোটের গোছা তার দিকে ছুঁড়ে দিলাম।
জুয়ার আসর আবার জমজমাট হয়ে উঠল। আমার দাম্ভিক মদমত্ত বন্ধুবর এবারও একের পর এক দারুণভাবে হারতে লাগল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সে আমার কাছে মোটা অর্থ ঋণী হয়ে গেল।
বন্ধুবর গ্লোণ্ডিনিং এবার কয়েক মুহূর্ত গুম হয়ে বসে রইল। আপন মনে কি যে ভাবল, সে জানে। তারপর একটা ভরা মদের বোতল বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে হাতে তুলে নিল। ছিপিটার সঙ্গে দাঁত আটকিয়ে এক হ্যাঁচকা টানে বোতলের মুখটা খুলে ফেলল। তারপর ঢ ঢক্ করে পুরো বোতলটা গলায় ঢেলে দিল। আমি সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ঠিক যেমনটা প্রত্যাশা করছিলাম–সে একেবারে হঠাই রেগে অগ্নিমূর্তি! কোনো সমস্যা নেই, দানের অঙ্কটা এবার দ্বিগুণ করা হোক, রাজি?
আমি কয়েকবার আমতা আমতা করতে লাগলাম। আসলে আমি অভিনয়ে লিপ্ত হলাম। এভাবে কয়েকবার অনিচ্ছার অভিনয় করে আমি তার আকস্মিক প্রস্তাবটায় সম্মত হয়ে গেলাম। আর এরই ফলে তার ধারের পরিমাণ এবার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে বাড়তে মিনিট কয়েকের মধ্যেই দ্বিগুণ হয়ে উঠল। আর এক ঘণ্টার তা চারগুণ হয়ে দাঁড়াল।
একটা ব্যাপারের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। গোড়ার দিকে ভাবলাম, আমার চোখ ও মনের ভুল, তারপর অনুসন্ধিৎসু চোখে ব্যাপারটাকে লক্ষ্য কওে নিঃসন্দেহ হতে পারলাম। হ্যাঁ, ঠিকই তো বটে, তার মুখের রক্তের ছোপটা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছিল। চকের মতো বিবর্ণ হয়ে পড়েছে।
আমি প্রথম দর্শনের পরই বিশ্বস্তসূত্রের মাধ্যমে খোঁজ লাগিয়ে জানতে পেরেছিলাম নতুন বন্ধুবর গ্লোণ্ডিনিং একজন সত্যিকারের ধনকুবের। তার মতো একজন ধনকুবের এতক্ষণ ধরে জুয়া খেলে যে পরিমাণ টাকাকড়ি হারিয়েছে তার জন্য তো এমন হতাশা আর হাহাকারে জর্জরিত হয়ে পড়ার কথা নয়।
আমি নিঃসন্দেহ হলাম, মাত্রাতিরিক্ত মদ গেলার ফলেই তার মধ্যে এমন আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে চলেছে। চোখ-মুখ অস্বাভাবিক বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। তাই উপস্থিত সবার কাছে ভালো মানুষ সাজার জন্য আমি কণ্ঠস্বর বেশ চড়িয়েই খেলা বন্ধ করার প্রস্তাব দিলাম।
হ্যাঁ, আমার মতলবটায় কাজ অবশ্যই হয়েছে। খেলা বন্ধ করে দেবার প্রস্তাব দিতেই উপস্থিত সবাই তারস্বরে চেঁচিয়ে প্রতিবাদ জানাতে লাগল। আর মাতাল গ্লোণ্ডিনিং সচকিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে গুঙিয়ে উঠল–‘না! কখনো না! খেলা বন্ধ করা চলবে না, কিছুতেই না।’
আমি নিজে এরকম একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে পড়লে কি যে করতাম তা বলা মুশকিল। সত্যি বলছি, নবাগত বন্ধু গ্লোন্ডিনিং-এর মর্মান্তিক দশা দেখে উপস্থিত সবার মন দারুণ বিষিয়ে উঠল। মিনিট কয়েকের জন্য ঘরটায় গভীর নীরবতা নেমে এলো। সবাই নির্বাক-নিস্তব্ধ। পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চলভাবে বসে রইল।
আমি লক্ষ্য করলাম, দলের সবার না হলেও অনেকেই আমার ওপর ক্ষুব্ধ। তারা ঘৃণাভরে বার বার আমার দিকে যে তাকাতে আরম্ভ করেছে তা-ও আমার নজর এড়াল না। তবে এক আকস্মিক ও অত্যাশ্চর্য ঘটনায় জগদ্দল পাথরের মতো চেপে-বসা দুঃসহ ভারটা বেশি না হোক, কিছুক্ষণের জন্য হলেও নেমে গেল। নিজেকে অনেকাংশে হালকা বোধ করতে লাগলাম। স্বস্তি পেলাম।
হঠাৎ হ্যাঁ, একেবারে হঠাই ঘরটার ভারী বড় সড় জানালাগুলো দুম্ করে পুরোপুরি খুলে গেল। পর মুহূর্তেই আরও বিস্ময়কর ভোজবাজির খেলা শুরু হয়ে গেল। যন্ত্রচালিতের মতোই সবগুলো মোমবাতি একই সঙ্গে নিভে গেল। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যেই ঘরের ভেতরের নিচ্ছিদ্র অন্ধকার নেমে এলো। আর সেই সঙ্গে শ্মশানেরনিস্তব্ধতা তো রয়েছেই।
বাইরে থেকে আসা চাঁদের হালকা আলোয় আমি শুধুমাত্র এটুকুই উপলব্ধি করতে পারলাম, আপাদমস্তক আলখাল্লায় ঢাকা অবিকল আমার মতোই লম্বাটে একজন। বিদ্যুৎগতিতে ভেতরে ঢুকে এলো। কেবলমাত্র দরজা দিয়ে ঢোকার সময় তাকে এক ঝলক দেখতে পেলাম। ভেতরে ঢোকার পরই মূর্তিটা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল।
আমি আগন্তুককে দেখতে না পেলেও এটুকু অবশ্যই উপলব্ধি করতে পারলাম, আমাদের মাঝখানে সে নীরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ঘরটার ভেতরে আমরা, যতগুলো প্রাণী অবস্থান করছি, সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লাম। কারো মুখে রা-সরছে না।
কয়েকমুহূর্ত পর সবার বিস্ময়ের ঘোর কেটে যাবার আগেই সে আগন্তুক, অনধিকার প্রবেশকারীর কণ্ঠস্বর কানে এলো।
আমি রীতিমত চমকে উঠলাম। শরীরের শিরা-উপশিরাগুলো যেন শিথিল হয়ে আসতে লাগল। রক্তের গতি হয়ে পড়ল দ্রুততর। আর বুকের ভেতরে কোনো অদৃশ্য হাত যেন অনবরত হাতুড়ি পিটে চলেছে।
হ্যাঁ, সে কণ্ঠস্বরটা আমি অন্তত স্পষ্ট শুনতে পেলাম। অনুমান অভ্রান্ত বলেই মনে হল। তার কণ্ঠস্বরই বটে। হুবহু সেই চাপা ফ্যাসাসে কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত কথাগুলো যেন আমার শরীরের হাড়গুলো ভেদ করে মজ্জায় গিয়ে আঘাত হানতে আরম্ভ করল, রীতিমত কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। কোনোদিনই সে কণ্ঠস্বর আমি স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারব না। কিছুতেই না।