আমার ভাবনা ওই আকস্মিক আর্বিভূত লোকটা আমার কাজে প্রতিবন্ধকতা করল, বিঘ্ন ঘটাল, অভিযোগের সুরে উপযাচক হয়ে আমাকে পরামর্শ দিয়ে গেল, তাকে যে আমি চিনতে পারিনি তা তো সত্য নয়।
মনের গোপন করে তা সত্ত্বেও জিজ্ঞাসা থেকেই গেল, কে ওই আগন্তুক কিশোর? কে-ই বা ওই উইলিয়াম উইলসন? কোথায় তার ঘর, এসেছেই বা কোত্থেকে? আর কোন দরকারেই বা এখানে এসেছিল, আমার সঙ্গে দেখা করেছিল? এরকম হাজারো প্রশ্ন আমার মাথার ভেতরে অস্থির পোকার মতো অনবরত কামড়াতে লাগল।
কিন্তু হায়! দীর্ঘসময় ধরে নিরলস প্রয়াস চালিয়েও ওইসব প্রশ্নের কোনোটারই উত্তর খুঁজে পেলাম না। মানসিক স্বস্তি কিছুতেই ফিরে তো পেলামই না, বরং অস্থিরতা হাজার গুণ বেড়ে গেল।
তবে চেষ্টা-চরিত্রের মাধ্যমে, কেবলমাত্র যেটুকু জানতে পারলাম, আমি যেদিন অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডা, ব্র্যান্সরির স্কুল ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলাম সেদিন বিকালেই তার পরিবারে একেবারে হঠাৎই একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। আর এরই ফলে তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। এছাড়া উপায়ও কিছু ছিল না।
আমি সে স্কুল ছেড়ে আসার পরই অক্সফোর্ডে যাওয়ার ব্যবস্থাদি করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরি। অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দেওয়ার অবসর ও মানসিকতা কোনোটাই সে মুহূর্তে আমার বিন্দুমাত্র ছিল না। তাই জোর তৎপরতার সঙ্গে উদ্যোগ-আয়োজন সেরে আমি দিন কয়েকের মধ্যেই অক্সফোর্ডে পারি জমালাম। আর সেখানে পা দিয়েই। আমি বাবা-মায়ের টাকাকড়ির জোরে বিলাসে মেতে গেলাম। যাকে বলে একেবারে লাগামহীন বিলাসে গা ভাসিয়ে দিলাম।
অক্সফোর্ডে পাঠাভ্যাস শুরু করতে না করতেই আমি এমন সব ঘৃণ্য, একেবারে জঘন্যতম কাজকর্মে মেতে উঠলাম, যে, জুয়াড়ির কাজকর্মের কৌশল রপ্ত করতেও আমি দ্বিধা করলাম না। এতটুকুও রুচিতেও বাঁধল না।
কয়দিনের মধ্যেই আমি একজন পয়লা নম্বরের জুয়াড়ি হয়ে গেলাম। জুয়ার দিকেই আমার দিনের একটা বড় অংশ কাটতে লাগল। সে কাজে আমার দক্ষতা উত্তরোত্তর বেড়েই যেতে লাগল।
সর্বজনবিদিত ও ঘৃনিত জুয়াখেলার জঘন্য কাজটায় আমি অতিমাত্রায় দক্ষতা অর্জন করে আমি কলেজের জনাকয়েক বোকা হাঁদার পকেট দেখতে দেখতে ফাঁকা করে দিলাম। আমার কলা-কৌশলে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। দিনের পর দিন জুয়া খেলায় জিতে আমি অচিরেই একজন টাকার কুমির বনে গেলাম আর অন্যরা হয়ে গেল পথের ভিখারী ।
আমি এভাবে রীতিমত দাপটের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের দুটো বছর কাটিয়ে দিলাম।
তারপর, হ্যাঁ তারপরই ‘গ্লোণ্ডিনিং’ নামধারী এক যুবকের আকস্মিক আবির্ভাব ঘটল। সত্যি কথা বলতে কি তার পরিচয়, এক ধনী যুবক। এর ওর মুখে শুনলাম, সে নাকি হেববাডেস এটিকাসের মতোই বিত্তশালী। যাকে বলে একজন ধনকুবের। আর যে ধন-সম্পদের পাহাড় আমার মতোই নির্ভেজাল সৎ পথেই অর্জিত। কিন্তু তার সে সৎ পথটা যে কি তার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা সে মুহূর্তে অন্তত করিনি।
আর কথাবার্তা ও কাজকর্মের মাধ্যমে এও বুঝতে পারলাম, তার মাথায় ক্ষার পদার্থ বলতে যা বোঝায় তা তিলমাত্রও নেই। পুরোটাই গোবর ভর্তি।
ব্যস, আমি মতলব এঁটে ফেললাম। কূট-কৌশলে আমি অচিরেই তাকে সাথে ভিরাবার জন্য তৎপর হয়ে পড়লাম। কাজ হাসিল করতে কিন্তু আমার মোটেই বেশি সময় তো লাগলই না। বরং অচিরেই আমার পবিত্র জুয়াখেলায় ভিড়িয়ে নিলাম।
কেউ নতুন খেলতে নামলে, খেলা শুরু করলে বিচক্ষণ ও চতুর জুয়াড়িরা গোড়ার দিকে তাকে জিতিয়ে দিয়ে তার লোভ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে আকাশ-ছোঁয়া করে তোলে। আমিও একই বুদ্ধি-কৌশলকে কাজে লাগিয়ে নবাগত যুবক গ্লোণ্ডিনিংকে জিতিয়ে দিয়ে তার আকর্ষণকে ক্রমেই বাড়িয়ে তুলতে লাগলাম।
হ্যাঁ, আমার মতলবটা পুরোপুরি কাজে লেগেছে। যুবক গ্লোণ্ডিনিং অচিরেই আমার ফাঁদে মাথা গলিয়ে দিল। তাকে কজা করে ফেলতে পারায় আমার মনে যে কী অব্যক্ত খুশির জোয়ার বয়ে গেল তা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।
একদিন মওকা বুঝে উভয়েই সহাধ্যায়ী মি. প্লেন্টনের ঘরে আট-দশজনের বেশ জোরদার এক জুয়ার আড্ডা গড়ে তুললাম। সবাই আমার কলেজের বন্ধু, সহায়ধ্যায়ী।
আগেই বলে রাখা দরকার, আমার মাথায় যে কূট একটা মতলব কাজ করছিল তার তিলমাত্রও উইলিয়াম উইলসন জানত না। আমার আচরণের মাধ্যমেও বদ পরিকল্পনাটার বিন্দুবিসর্গও টের পায়নি।
সে যা-ই হোক, অনেক রাতে প্রায় গভীর রাতে জুয়াখেলা শুরু হয়। মদের নেশায় ধনকুবের ছাত্রটা একেবারে কুঁদ হয়ে আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে। কয়েক মুহূর্ত চোখ দুটো আধ-বোজা অবস্থায় বসে মদের জাঁকিয়ে বসা নেশাটাকে উপভোগ করল। এবার শুরু করল জুয়ার দান চালা।
ব্যস, আর যাবে কোথায়। সে যতইবারই দান চালল, ততবারই গো-হারা হেরে গেল। রাশি-রাশি কাড়িকাড়ি নোট সে পকেট থেকে বের করতে লাগল। আর প্রতিবারই নোটগুলো আশ্রয় নিতে লাগল আমার পকেটে। ফলে তার পকেট ক্রমে হালকা হয়ে আমার পকেটগুলো ফুলে ফেঁপে রীতিমত ঢোল হয়ে উঠতে লাগল।
এদিকে কার্যত দেখা গেল, গ্লোন্ডিনিং যত হারে তার জেদও ততই উৰ্দ্ধমুখি হতে লাগল। মোদ্দা কথা, সে যেন রীতিমত ক্ষেপে গেল। এখন তার পকেট একেবারেই শূন্য। একটা কানাকড়িও তার কাছে আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু নিজেকে সংযত রাখা এখন তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু উপায়? জেদ বজায় রাখতে হলে উপায় তো একটা