তারপর ইনটন-এর স্কুলের খাতায় নাম লেখালাম। সেখানে নতুন করে পাঠাভ্যাস চালাতে লাগলাম।
এই অল্প সময়ের মধ্যেই আমার মন থেকে অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডাঃ ব্র্যানসবির পাঠশালার অবাঞ্ছিত ঘটনার স্মৃতি অনেকাংশে ম্লান হয়ে গেল। ভয়ঙ্কর সে নাটকের সে দৃশ্যটার চিহ্নমাত্রও আমার মনে আর অবশিষ্ট থাকল না। পুরো ব্যাপারটাকেই আমি সাময়িক চোখ ও মনের ভুল বলেই ধরে নিলাম। তাই তার লেশমাত্রও আর মনের গভীরে টিকে থাকার কথাও নয়।
তারপর শোচনীয় স্বেচ্ছাচার আমার জীবনের সর্বক্ষণের সঙ্গি করে নিলাম। স্কুলের প্রচলিত নিয়ম কানুন, কড়াদৃষ্টিকে কিছুমাত্রও আমল না দিয়ে চলতে লাগলাম। আমার তখনকার আচরণের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা আর করলাম না। আর সে বিবরণ দিতে গেলে রীতিমত একটা পুস্তিকা তৈরি হয়ে যাবে। অতএব ব্যাপারটা চেপে যাওয়াই সব দিক থেকে মঙ্গল।
সত্যি কথা বলতে কি, তিন-তিনটা বছরের বোকামির ফলে ফায়দা কিছুই হলো না। যা পেলাম তা হলো কেবলমাত্র কিছু পাপ কর্মের পাকাপাকি অভ্যাস।
একটা সপ্তাহ ধরে দৈহিক ভ্রষ্টাচারের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে একদিন আমি একদল চরম বখাটে ছাত্রকে আমার ঘরে ডেকে নিয়ে এলাম। উদ্দেশ্য, তাদের নিয়ে গোপনে কিছু আনন্দ-ফুর্তি করে মনটাকে একটু চাঙা করে নেয়া।
তারা আমার ঘরে একটু বেশি রাতেই হাজির হল। আলোচনার মাধ্যমে আগেই পরিকল্পনা করে নিয়েছিলাম, ভোর পর্যন্ত সবাই হৈ-হুঁল্লোড়ে মেতে থাকব।
আমরা অফুরন্ত উন্মাদনায় মত্ত হয়ে একের পর এক মদের বোতল খুলে গলায় ঢালতে লাগলাম। কেবলমাত্র যে গলা পর্যন্ত মদ গিলেই আমরা সেদিন ক্ষান্ত দিয়েছিলাম তাই নয়। সে আরও বহুরকম মারাত্মক বিপজ্জনক প্রলোভন তো ছিলই। ফলে ভোরের আলো যখন একটু একটু করে ফুটতে শুরু করল তখন আমাদের আনন্দ-ফুর্তি চরম রূপ ধারণ করল।
তখন মদ আর তাসের নেশায় একেবারে বদ্ধ উন্মাদ বনে গেছি। আর কারণে অকারণে একে ওকে অনবরত অকথ্য গালিগালাজ করে চলেছি। আমাদের, বিশেষ করে আমার মুখে যেন খই ফোঁটার মতো খিস্তি বেরোতে আরম্ভ করল।
আচমকা ঘরের দরজার পাল্লা দুটো সামান্য ফাঁক হল। পরিচারকের কথা শুনতে পেলাম। চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়েই সে বলল, কে একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। জরুরি দরকার। হলঘরে অপেক্ষা করছে।
মদের নেশায় আমার মধ্যে তখন উন্মত্ততা জাগিয়ে তুলেছে। ফলে হঠাৎ মজা লোটার বাধা পড়ায় অবাক না হয়ে আমি বরং আনন্দিতই হলাম।
চাকরের তলব পেয়েই আমি মদের ঘোরে টলমল শরীরটাকে কোনোরকমে টানতে টানতে হলঘরের দিকে হাঁটতে লাগলাম।
সামান্য এগিয়েই বাড়ির বারান্দার লাগোয়া ঘরটার দরজায় হাজির হলাম। ঘরটা ছোট্ট। ফলে জানালা দিয়ে সবে ভোরের আলো ফুটে ওঠা হালকা আলো ছাড়া ঘরে আর কোনো বাতির আলো ছিল না। তাই ঘরটা প্রায় অন্ধকারই ছিল।
আমি টলতে টলতে এগিয়ে গিয়ে দরজার চৌকাঠের গায়ে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তেই চোখে পড়ল আমার মতোই লম্বাটে এক কিশোরের মূর্তি ঘরটার ভেতরে অবস্থান করছে। তার পরনে একটা সাদা ফ্র। তখন আমার পরনে যেমন জামা ছিল, ঠিক সেরকমই একটা ফ্রক আগুন্তুক কিশোরটা ব্যবহার করেছে। ভোরের হালকা আলোয় এটুকু কোনোরকমে দেখতে-বুঝতে পারলাম। কিন্তু ক্ষীণ আলোয় তার মুখটা ভালো দেখতে পেলাম না। আমি চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরের ভেতরে পা দিতেই সে ব্যস্ত-পায়ে এগিয়ে এসে খুবই অস্থিরভাবে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরল।
আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই আগন্তুক কিশোরের মূর্তিটা একেবারে যন্ত্রচালিতের মতো নিজের মুখটাকে আমার কানের কাছে নিয়ে এসে অনুচ্চকণ্ঠে, একেবারই ফিসফিসানির স্বরে বলে উঠল–‘উইলিয়াম উইলিয়াম!
আকস্মিক চাবুক খেয়ে আমি যেন মুহূর্তের মধ্যেই সম্বিৎ ফিরে পেলাম। সচকিত হয়ে ঝট করে একেবারে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
অপরিচিত আগন্তুকের চালচলন দেখে আর যেভাবে সে আমার চোখ দুটো আর আলোর মধ্যবর্তী স্থানে তর্জনি তুলে বার বার নাড়াতে লাগল তা লক্ষ্য করে আমি যারপরনাই অবাক হয়ে গেলাম। আমি যেন মুহূর্তে বাশক্তি হারিয়ে ফেললাম। কাঠের পুতুলের মতো নিশ্চল-নিথরভাবে দাঁড়িয়ে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই যেন করার ক্ষমতা আমার মধ্যে ছিল না।
খুবই সত্য যে, কেবলমাত্র এটাই কিন্তু আমাকে এমন অভাবনীয় বিচলিত করে তোলেনি। তবে? তার সে অত্যাশ্চর্য রকমের হিস্ হিস্ করে বলা শব্দ দুটোর মধ্যে যেন এক গোপন তাৎপর্যপূর্ণ ভর্ৎসনার সুর বাজছিল। সবার ওপরে ওই দুটো সহজ সরল শব্দ, সুপরিচিত অথচ অনুচ্চ-অস্পষ্ট স্বরে বলা কথার বৈশিষ্ট্য আর বক্তব্য আমার ভেতরে অতীতের বহু, বহু স্মৃতিকে মুহর্তে মনের গভীরে জাগিয়ে তুলল। আমার অন্তরাত্মায় তীব্র খোঁচা মেরে সচকিত করে তুলল।
আমি যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম। চোখ আর কানকে নতুন করে পুরোপুরি সজাগ করতে পারলাম তখন দেখলাম, কামরার মধ্যে সে অনুপস্থিত–উধাও হয়ে গেছে। চোখের ভুল ভেবে সাধ্যমত অনুসন্ধিৎসু চোখে ঘরটার সর্বত্র তাকিয়ে দেখলাম, সত্যি সে যেন কর্পূরের মতোই উবে গেছে। স্তম্ভিত হলাম।
ব্যাপারটা নিয়ে সপ্তাহ কয়েক গভীর ভাবনায় ডুবে রইলাম। অদ্ভুত অদ্ভুত সব কল্পনা আমার মাথার ভেতরে জট পাকাতে লাগল।