একটু আগে যে উইলিয়াম উইলসনের গায়ে হাত দেবার ঘটনার উল্লেখ করেছি, সে ঘটনার ঠিক পর পরই, আমার স্কুলে ভর্তির ঠিক পাঁচ বছরের শেষার্ধের এক রাতের কথা বলছি। আমি তক্কে তক্কে ছিলাম, বাড়ির অন্য সব ছাত্ররা ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি খুবই সন্তর্পণে, যাকে বলে একেবারে পা টিপে টিপে নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।
আগের মতোই সন্তর্পণে বারান্দাটা পেরিয়ে উইলিয়াম উইলসনের শোবার ঘরের দরজায় গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। উত্তর্ণ হয়ে লক্ষ্য করলাম, সে ঘুমিয়ে পড়েছে, নাকি জেগে আছ? মোটামুটি নিঃসন্দেহ হলাম, ঘুমিয়েই পড়েছে। এবার দরজায় মৃদু আঘাত করলাম। না, ভেতর থেকে কোনো শব্দই ভেসে এলো না। সে যে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে এ ব্যাপারে আমার মনে আর সামান্যতম সন্দেহই রইল না।
ব্যস, আর মুহূর্তমাত্রও দেরি না করে আমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলাম।
সত্যি কথা বলতে কি, একটা কূটবুদ্ধির খেলায় তাকে ঘায়েল করে তৃপ্তি লাভের প্রত্যাশা বুকে নিয়ে উপযুক্ত সুযোগের প্রত্যাশায় তক্কে তক্কে ছিলাম। দীর্ঘ প্রতীক্ষার। পর এবার বাঞ্ছিত সে মওকাটা হাতের মুঠোয় পেয়ে গেলাম।
আমি খুবই সন্তর্পণে, যাকে বলে অবিকল বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে তাকের ওপরে রক্ষিত জ্বলন্ত বাতিটাকে চাপা দিয়ে আবার একই রকম সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। ঢাকা দেওয়া বাতিটাকে বাইরে রেখে দিয়ে আবার ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলাম।
দুপা এগিয়ে আমি একেবারে তার চৌকিটা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে একটু উৎকর্ণ হয়ে তার নিশ্বাসের শব্দ লক্ষ্য করলাম।
সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হলাম, সে সত্যি সত্যি গভীর ঘুমে ডুবে রয়েছে।
ঘর থেকে আবার বেরিয়ে বাতিটা হাতে করে আবার ঘরের ভেতরে গেলাম। মশারি টাঙিয়ে সে শুয়েছিল। সেটা ফেলাই রয়েছে।
মশারিটা সামান্য ফাঁক করে বাতিটা ভেতরে ঢুকিয়ে নিতেই উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা তার ঘুমন্ত মুখের ওপর পড়ল। আমি অপলক চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি নিরবচ্ছিন্নভাবে তার মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধই রাখলাম।
মুহূর্তের একটা অভাবনীয় অসাড়তা, বরফের মতো ঠাণ্ডা ভাব যেন আমাকে গ্রাস করে ফেলল। সত্যিকারের অভাবনীয় একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম আমি।
কেবলমাত্র আমার বুকের ভেতরে যে ধুকপুকানিই শুরু হয়ে গেছে তা-ই নয়, হাঁপরের মতো বুকটা বার বার ওঠানামা করতে লাগল। আর হাঁটু দুটোও থর থর করে। কাঁপতে আরম্ভ করে দিল। কী যে অত্যাশ্চর্য রীতিমত অকল্পনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি আমি হলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা মোটেই সম্ভব নয়। অহেতুক একটা আতঙ্ক আমাকে যেন পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলল।
আমি আরও অনেক, অনেক বেশি মাত্রায় হাঁপাতে আরম্ভ করলাম। হাঁপাতে হাঁপাতেই আমি মোহমুগ্ধের মতো জ্বলন্ত আলোটাকে তার আরও কাছে নামিয়ে নিলাম।
আমি একেবারে হঠাৎই সচকিত হয়ে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়লাম। শরীরের সব কয়টা স্নায়ু যেন একই সঙ্গে ঝনঝনিয়ে উঠল। বুকের ঢিবঢিবানিটা আরও অনেকাংশে বেড়ে গেল।
কে? কে এটা? উইলিয়াম উইলসন? এটা কি উইলিয়াম উইলসনেরই মুখ? আমার চোখের সামনে কে শুয়ে রয়েছে।
হ্যাঁ, আমি ঠিক তাই দেখলাম। সত্যি সত্যি উইলিয়ামই বটে। কেন আমার মন এমন বিপরীত ভাবনার শিকার হয়ে গেল–কিভাবে? কেনই বা অসহ্য আতঙ্কে ভরে উঠল? অব্যক্ত তীব্র যন্ত্রণায় আমি যেন কেমন কুঁকড়ে যেতে লাগলাম।
কেন? কেন? কেন আমার মন এমন অকল্পনীয় আতঙ্কে ভরে উঠল? এমনকি রয়েছে তার মুখে যা আমাকে এতটা বিচলিত আতঙ্কিত করে তুলল?
ভাবলাম, হয়তো বা চোখ আর মনের ভুলের জন্যই আমি এমন একটা অভাবনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে পড়েছি। আবারও তার মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগল। কিছুটা সময় এলোমেলো হরেক রকমের চিন্তা আমার মাথায় আশ্রয় নিয়েছে। মাথাটা বার বারই চক্কর মেরে উঠতে লাগল। আর কানের ভেতরে শুরু হলো দদপানি।
হায় ঈশ্বর! এ কী দেখছি! এ আমি কাকে দেখছি! কিন্তু জাগ্রত আমার উইলিয়াম উইলসন তো এমনটা দেখতে নয়, কিছুতেই নয়। তবে? তবে চোখের সামনে এ আমি কাকে দেখছি! একই নাম-পদবী! একই দৈহিক গঠন! তারপর দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে আমার চালচলন অনুকরণ। নিরবচ্ছিন্ন প্রয়োগের মাধ্যমে আমার আচরণ আর স্বভাব নিখুঁতভাবে নকল করা–এ কী রক্ত-মাংসে গড়া কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব? এই মাত্র চোখের সামনে যা চাক্ষুষ করলাম, তা কি তবে এ ব্যাঙ্গাত্মক অনুকরণের, নিরবচ্ছিন্ন অনুকরণের ফল ছাড়া কিছু নয়?
আতঙ্কে বার বার শিউরে উঠে ফুঁ দিয়ে হাতের বাতিটাকেনিভিয়ে দিলাম।
অসহ্য! রীতিমত অসহনীয় পরিস্থিতির শিকার হওয়ায় আমার মধ্যে অসহনীয় অস্থিরতা ভর করল। আর এক মুহূর্তও পুরনো পাঠশালা-বাড়িটায় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না।
আমি আগের চেয়েও সন্তর্পণে নিঃশব্দে তার ঘরটা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে সদর দরজার বাইরে চলে এলাম।
আর কোনোদিন, একটা মুহূর্তের জন্যও আমি সে বাড়িটার ভেতরে ঢুকিনি। আমাকে জোর করেও কেউ আর সেখানে পাঠাতে পারেনি। অলসতা, শুধুমাত্র অলসভাবে শুয়ে বসে আরও মাসকয়েক আমি বাড়িতেই কাটিয়ে দিলাম।