রবি আমার নিথর চক্ষু তারকার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে গেছিল—ইন্দ্র, ছোট্ট এই পাথরটার ওজন সাড়ে তিন ক্যারাট। আদতে হিরে কিনা, তা যাচাই করার জন্যে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল টেন পাওয়ার ম্যাগনিফাইং গ্লাস–হিরে বাণিজ্যে যে জিনিসটা অপরিহার্য। হিরে চিনতে হলে, বিশেষ এই আতস কাচ দরকার ‘ আমি সেই কাচের মধ্যে দিয়ে যা দেখেছিলাম, তা আমার চক্ষু চড়কগাছ কবার পক্ষে যথেষ্ট।
আমি বলেছিলাম, রবি, তুই তো একটা পয়মাল। সহজে তাজ্জব হোস না। কি দেখেছিলি?
দেখেছিলাম দুটো হিরে গায়ে গায়ে জুড়ে রয়েছে। গলে গিয়ে জুড়ে গেছে। ধরণী তার জঠরের কল্পনাতীত তাপ দিয়ে দুটো দু’রকমের হিরেদের একসঙ্গে জুড়ে রেখে দিয়েছে।
আজ, এতদিন পরে, সেই কাহিনি লিখতে বসে আমার মনে হচ্ছে, রবি যেন ওর ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষ করেছিল সেই যমজ হিরের মধ্যে। দুটো দুরকমের হিরে। একটা ও নিজে, আর একটা ওর ভাগ্যাকাশের শনি নক্ষত্র-কল্পনা।
রোমন থাক। সেদিনের কথায় আসি।
রবি বলে গেছিল—যমজ হিরে নিয়ে শুরু হয়েছিল দর কষাকষি! খনি শ্রমিক গ্যারিমপিয়োস যে হিরে বণিকের সামনে যমজ হিরে দেখিয়েছিল, তার নাম কাবেনজেলি। ছোট্ট একটা পকেট ক্যালকুলেটর বের করে সে খুটখাট করে হিরের দাম ফুটিয়ে তুলেছিল স্ক্রীনে। সাড়ে সাতশ ডলার। টেবিলের ওপর দিয়ে ক্যালকুলেটর ঠেলে দিয়েছিল হিরে যে খুঁড়ে তুলেছে—তার দিকে। সে দাম চেয়েছিল ২২০০ ডলার। ক্যালকুলেটর যাতায়াত করেছে টেবিলের এদিক থেকে ওদিকে। ওদিক থেকে এদিকে। দাম উঠেছে পড়েছে নিঃশব্দে—মুখে কোনও কথা নেই। শেষ পর্যন্ত রফা হয়েছিল ১৬০০ ডলারে। যমজ হিরে আমার পকেটে এল ২০০০ ডলারের বিনিময়ে। মস্ত ঝুঁকি নিলাম। হিরে ব্যবসাতে আজ যে রাজা, কাল সে ফকির হয়ে যেতে পারে, ফকির হয়ে যেতে পারে রাজা।
রবির চোখে চোখ রেখে আমি বলেছিলাম, তুই কি হয়েছিস?
যমজ হিরেকে পকেটে চালান করতে করতে রবি বলেছিল, এই মুহূর্তে রাজা। কেন না, ডবল দামের খদ্দের এসে গেছে হাতে।
বেরসিকের মতো আমি বলে ফেলেছিলাম, রবি, হিরে নিয়ে তুই কি শুধু দালালিই করেছিস? খনি থেকে হিরে তোলা দেখিসনি?
অট্টহেসে রবি তখন বলে গেছিল ওর দুর্ধর্ষ জীবনের অনেক গুপ্ত কাহিনি। যে সব কাহিনি প্রকাশ্য হলে ওর জীবন বিপন্ন হতে পারে। হিরে তোলার জাহাজে চেপে ও পাড়ি দিয়েছে মরুভূমির উপকূল থেকে আঠারো মাইল দূরের সমুদ্রে। সেই মরুভূমির নাম নামিবিয়া। দেখেছে কীভাবে সতেরো ফুট চওড়া ড্রিল ঢুকে যাচ্ছে দক্ষিণ আটলান্টিকের তিনশো ফুট গভীরে। টেনে তুলছে প্রতি ঘণ্টায় তিনশো মেট্রিক টন সমুদ্রতল—একটানা-বিরামবিহীনভাবে—দিনে আর রাতে-সাতদিন, সাতৃরাত।
ভাসমান খনি? নিরুদ্ধ নিঃশ্বাসে বলেছিলাম আমি।
হ্যাঁরে! গত দশ কোটি বছরে অরেঞ্জ নদী কত হিরে ধুইয়ে নামিয়েছে সাগরের জলে, তার একটা হিসেব করে নেওয়া হয়েছিল আগেই—পরিসংখ্যান হিসেব। সেই হিসেবেই ভাসমান খনি ভেসেছিল সাগরের জলে মাসে উনিশ হাজার ক্যারাটের হিরে তোলার টার্গেট নিয়ে…
উনিশ হাজার ক্যারাট!
আজ্ঞে।
হিরের ঝলকানি চোখ ঝলসে দেয়নি?
দূর! হিরে তো দেখিনি।
তবে?
শুধু পাথর আর সাগরের জঞ্জাল!
০৮. লরি বোঝাই হিরে
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা আমার কোষ্ঠীতে লেখা নেই। আমি যে ইন্দ্রনাথ রুদ্র! চমক দিয়ে যাই, নিজে চমকাই না। কিন্তু সেইদিন, বন্ধুবর রবি রে’র অতি অদ্ভুত জীবন কাহিনি শুনতে শুনতে বিষম চমক খেয়েছিলাম।
বলে কি রবি! সাগর গর্ভ থেকে স্রেফ জঞ্জাল তুলেছে হিরে তুলতে গিয়ে! বিপুল অর্থ ব্যয় করে! বলেছিলাম, নুড়ির মধ্যে থেকে হিরে খুঁজতে?
ও বলেছিল, সত্যিই তাই। ইন্দ্র। আমরা এই ঘরকুনো তাস, দাবা, পাশা বিলাসী বঙ্গতনয়রা এই জাতীয় অ্যাডভেঞ্চারাস সওদাগরি ভেঞ্চার কল্পনাতেও আনতে পারব না–
প্রতিবাদ জানাচ্ছি, আমি বলেছিলাম, এই বাংলার বণিকরা একদা সপ্ত ডিঙা ভাসিয়ে সপ্তদ্বীপে বাণিজ্য করেছে—
সে সব দিন গেছে। এইভাবে হিরে তোলার ভাসমান খনি ভাসিয়েছিল কিনা জানা নেই। কিন্তু আমি যে সেই অ্যাডভেঞ্চারের পিপাসা নিয়েই দেখতে গেছিলাম। হিরে চিরকাল রমণী নয়নে মোহ বিস্তার করেছে, আমি সেই হিরে নিয়ে মেতেছিলাম…।
একটু বাগড়া দিয়েছিলাম, কল্পনার কল্পনায় আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে?
কথাটা বলেছিলাম কিঞ্চিৎ হাস্য সহকারে। হাস্য বিবিধ প্রকারের হয়–এক চিলতে হাসি দিয়ে হাজার কথা বলে ফেলা যায়-মুখে উচ্চারণ না করে হাসি-বিজ্ঞানের এই তত্ত্ব রসিক পাঠক এবং সুরসিকা পাঠিকার অজ্ঞাত নয়।
আমার বহু অর্থব্যঞ্জক টিপ্পনি যেন কানেই তুলল না চৌকস রবি রে। বললে, রমণীগণ মুগ্ধ হন বলেই তো পুরুষ মহাশয়রা জীবন বিপন্ন করে সাগর ঘেঁচে আব পাতাল খুঁজে হিরে খুঁড়ে, হিরে খুঁজে বেড়ান। হ্যাঁ, হ্যাঁ, হা-কল্পনা আমাকে ইন্সপায়ার করে গেছে। তাই অত ঝুঁকি নিয়েছিলাম। কল্পনার কল্পনায় আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো কাণ্ড করে গেছিলাম। সেটা শুধু হিরের লোভে নয়, টাকার খোঁজে নয়—
জানি, কণ্ঠস্বর থেকে পরিহাসকে নির্বাসন দিয়ে শুধিয়েছিলাম, কল্পনার মনের পটে হিরে নয়, হিরে নক্ষত্র হতে। সে কথা থাক। প্রেম পুরুষমাত্রকেই ভেড়া বানায়। তাই আমি ওই বস্তুটাকে পরিহার করি। কিন্তু এবার বল, সাগর ঘেঁচা জঞ্জাল নিয়ে কী করা হলো?