এই তল্লাটেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিল রবীন্দ্ররঞ্জন রায়বর্মণ। বিশাল নাম। কিন্তু মানুষটার সাইজ অতবড় নয়। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি হাইটের পাতলা হিলহিলে একটা মানুষ। অতিশয় ডাকাবুকো। পাড়ার হাওয়া গায়ে লাগিয়ে বড় হতে হতে সে অনেক কাণ্ড করে ফেলেছে। বোমা বেঁধেছে, বোমা মেরেছে, বেপাড়ার মস্তানদের মুচিপাড়ায় মস্তানি করতে দেয়নি। মেয়েদের সম্মান দিয়ে গেছে, মেয়েরাও ওকে বিপদ-আপদের পরম বন্ধু বলে জেনেছে।
কিন্তু অতবড় নাম নিয়ে কি কেউ বড় হতে পারে? জেট যুগে এ নাম অচল। তাই স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে যখন বেরিয়ে এল দামাল মানুষটা, তখন ওর নাম কাটছাঁট করে এসে দাঁড়ালো রবি রে’তে।
এইবার শুরু হল ওর অবিশ্বাস্য দুঃসাহসিক জীবনের আর এক পর্ব। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ নিয়ে গোটা ভারতে চক্কর মারার সময়ে বোম্বাইয়ের হিরে কারবারিদের সংস্পর্শে এসেছিল রবি রে। ওর মধ্যে যেন একটা ন্যাচারাল ম্যাগনেট আছে। অজানার দিকে ছুটে যাওয়ার ম্যাগনেট। যেখানে রহস্য, সেইদিকে ধেয়ে যাওয়ার প্রবণতা। ভারত ভ্রমণের এই চাকরিতে ঢুকেছিল আতীব্র এই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই। বোম্বাইতে ওকে টেনে ধরল এই পৃথিবীর হিরে কারবারিদের আশ্চর্য দুনিয়া। হিরের টুকরো ছিল ছেলেবেলা থেকেই। এখন সে চলে গেল প্রকৃত হিরের জগতে…
সুদীর্ঘ সেই কাহিনি সবিস্তারে লিখতে গেলে, এই উপাখ্যান একটা থান ইটের মতো ভারি হয়ে যাবে। হিরের দুনিয়াটাই যে রোমাঞ্চকর। রোমাঞ্চ স্পৃহা যার প্রতিটি রক্তকণিকায় নৃত্য করে যায়, সে তো রোমাঞ্চময় হিরের কারবারের একদম ভেতরে ঢুকে যাবেই। অসম্ভব ডানপিটে, অসম্ভব কৌতূহলি, অসম্ভব উপস্থিত বুদ্ধির মানুষ রবি রে। তাই একটা সময়ে আপন রশ্মি বিকিয়ে দুনিয়া জোড়া হিরে আবাদের নাড়ি-নক্ষত্র আঙুলের ডগায় জড়ো করে নিয়েছিল।
শুরু হয়েছিল লোপাট হয়ে যাওয়া বিশাল এক হীরক খণ্ড থেকে। আকাটা হিরে। ওজন ২৬৬ ক্যারাট। পাঠক এবং পাঠিকার অবগতির জন্যে জানিয়ে রাখি, এক গ্রাম ওজনের এক পঞ্চমাংশ হল এক ক্যারাট।
বোম্বাইয়ের গদি থেকে বিপুলাকার এই হিরের অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে গোপন তদন্ত অভিযানের প্রয়োজন হওয়ায় তলব পড়েছিল আমার। এই হিরে এসেছিল কঙ্গোর খনি থেকে। নিরুদ্দেশ হওয়ার পর সেই হিরেকে খুঁজে বের করেছিলাম নিউইয়র্ক সিটিতে। হিরের খোঁজে থেকেই কোটি কোটি ডলারের খনির খোজ পেয়েছিলাম, রক্তাক্ত সংঘর্ষের বিবরণ পেয়েছিলাম।
মূলে শুধু হিরে! কয়লা থেকে জন্ম নেওয়া একটা পাথর। মহাকাল বুঝি স্তব্ধ হয়ে যায় তার রূপের সামনে। রূপমী হীরক। তোমাকে নমস্কার। হিরের ডিমের প্রসঙ্গে এবার ফিরে আসা যাক। এবং সে কাহিনি শোনানো যাক হীরক-কন্যা কল্পনা চিটনিসের জবানিতে ।
০৪. কল্পনার ছলনা কাহিনি
রবি আমার থুতনি নেড়ে দিয়ে বলত, কল্পনা আমার কল্পনা, ছলনাময়ী ললনা, কামরূপ থেকে কী শিখে এলে, বল না প্রিয়া, বল না!
আমি ওর বিদ্যুৎ চঞ্চল চোখে চোখ রেখে বলতাম, পঞ্চবাণ, পঞ্চবাণ!
ও বলত, কী নাম? কী নাম?
আমি বলতাম, সম্মোহন, উন্মাদন, শোষণ, তাপন আর স্তম্ভন।
ও বলত, তোমার ঘোট ঘোট চোখে তাই বুঝি এত বিদ্যুৎ।
আমি রেগে যেতাম। এই একটি ব্যাপারে খোঁচা মারলে মেজাজ খিঁচড়ে যেত। হ্যাঁ, আমার চোখ ছোট। একটু তেড়চাও বটে। মায়ের দিক থেকে পেয়েছি। মা ছিল হিমালয়ের মেয়ে। হিমকন্যাদের চোখ ওই রকমই হয়। দীঘল চোখ যাদের থাকে, তাদের মনের তল খুঁজে পাওয়া যায়। চোখ যে মনের আয়না। খুদে চোখে সেই মন সবটুকু ভেসে ওঠে না। আমারও ওঠে না। আমি গহন গভীর মনের অতল কোণে লুকিয়ে রেখে দিতাম আমার আসল চাহিদা। আমি চাই হিরে…এই পৃথিবীর জঠর থেকে তুলে আনা কঠোর পাথর, যার জলুস আর যার হিপনোটিক দ্যুতি বাড়িয়ে দিক আমার কামরূপ বিদ্যা।
না, কামরূপ-টামরূপ আমি যাইনি। কিন্তু চলমান চুম্বকের মতো যে কোনও পুরুষকে আমি টেনে ধরে নিংড়ে নিতে পারি। তাতেই আমার আনন্দ, তাতেই আমার আবেশ।
রবি রশ্মিকে আমি টেনে ধরেছিলাম ঠিক এই মতলবেই। সে যে নিখাদ হিরে, তা তো আমা;, জহুরি চোখ দিয়েই যাচাই করে নিয়েছিলাম। আমরা মেয়েরা এই একটি ব্যাপারে ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা রাখি। বিশেষ করে আমি রাখি। কারণ আমি হিমালয়ের মেয়ে। পুরাণ-টুরাণে আমাদেরকেই বলা হয়েছে বিদ্যাধরী। হিমলোক থেকে নেমে এসে মর্ত্যলোকের সুধা পান করে গেছি চিরকাল। করছি এখনও, নিংড়ে নিচ্ছি এই হীরক-যুবক রবি রে’র সত্তা থেকে।
নানান নিভৃত জায়গায় প্রেমালাপের সময়ে রবি আমাকে বলে গেছে ওর হীরক অনুসন্ধানের শিহরণ জাগানো কাহিনি। ওর মুখেই শুনেছি, হিরে ওকে টানে…ওর অণু-পরমাণুতে টান ধরায়। ও বোধহয় আগের জন্মে জহুরি ছিল…মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে হিল্লিদিল্লি ঘুরতে ঘুরতে বোম্বাইয়ের জহর বাজারে যেদিন থেকে ঢুকেছে, সেইদিন থেকে পূর্ব-পূর্ব জন্মের নেশা যেন ওকে পাগল করে দিয়েছে। ও যখন হিরে নিয়ে কথা বলত, তখন সত্যিই যেন ও আর এক মানুষ হয়ে যেত…ওর চোখের তারায় তারায় হিরের জলুস, হিরের কিরণ, হিরের কাঠিন্য দেখতে পেতাম।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, হিরের কাঠিন্য। কঠিন কঠোর কুলিশ কালো হয়ে যেত ওর দুই কনীনিকা। ওর অতীতু আমি জানি। আমাকে বলেছে মরণকে ও ডরায়নি। আজও ডরায় না। তাই প্রাণের পরোয়া না করে হিরের টানে ঢুকে গেছিল হিরের জগতে।