তাই, পুলিশ পুঙ্গবীর নয়ন বাণ আমাকে বিধতে পারেনি। তিনি যে মনের মতো পুরুষের পথ চেয়ে বসেছিলেন, তা জেনেছিলাম পরে। তখন আর আঁখির ভাষা প্রয়োগ করেননি, মুখের ভাষায় এই শর্মাকে কজায় আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি যে নিরুপায়। কবিতা বউদির ওই চোখেব শাসন মনে করলেই আমি পাথর হয়ে যাই।
যাগ গে, যাক গে, কথায় কথায় উপসংহার দীর্ঘ করে ফেলছি। কাজের কথায় আসা যাক।
পুলিশ পুঙ্গবীর ম্যাগনেটিক চাহনি এড়িয়ে গেছিলাম সে সিসের টুকরোর মতো। বলেছিলাম, ম্যাডাম, আপনার সায়েন্টিফিক ইনভেসটিগেশন ডিপার্টমেন্ট তাহলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলিয়ে প্রমাণ পেয়ে গেছে?
পু—পু বললেন, ইয়েস, স্যার। কম্পিউটার ভেরিফিকেশন হয়েছে। সাদা ভানের নানান জায়গায় যে সব আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে বহু ফিঙ্গারপ্রিন্ট নাইজেলের। একদা যে ছিল সাউথ আফ্রিকার মোস্ট ড্রেডেড ক্রিমিন্যাল।
ইণ্টারন্যাশন্যাল পুলিশ তাকে খুঁজছিল?
ইউনাইটেড নেশনের ইণ্টারন্যাশন্যাল ওয়ারক্রাইম অ্যাক্ট অনুসারে।
পৃথিবীজোড়া সন্ত্রাসে যুক্ত বলে?
হ্যাঁ। কিন্তু, মিস্টার রুদ্র, আপনি তা জানলেন কী করে?
ম্যাডাম, আমি যে গোয়েন্দা। এই পৃথিবীর অন্যতম সেরা গোয়েন্দা সংস্থা প্রেমচাঁদ ডিটেকটিভ এজেন্সির কর্ণধার প্রেমচাঁদ মালহোত্রা আমার কলেজ ফ্রেণ্ড। যা কিছু জেনেছি, তারই দৌলতে। সে যে সোর্স ইনফর্মেশন নিয়ে কাজ করে। আমার কেরামতি শুধু বুকের পাটা দেখিয়ে এখানে এসে বসা।
কিন্তু, আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, পুলিশ পুঙ্গবী—আপনি তো এসেছিলেন, ডোন্ট মাইণ্ড ফর মাই ফ্র্যাঙ্কনেস, মিসেস কল্পনা রে-চিটনিসের ফ্রেণ্ড হিসেবে।
এই কথায় আমার পাশের দু’জন আড়ষ্ট হয়ে গেছিল। তাদের একজন কল্পনা, অপরজন রবি।
সোমনাথকে এ ঘরে রাখা হয়নি। সে পাশের ঘরে গেমস ফ্রিক খেলছে। কালিকা রানির চাঁচাঁ চিল্লানি এ ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে।
আমি বললাম, ম্যাডাম, তাহলে একটু খুলে বলা দরকার। পুলিশ, উকিল আর ডাক্তারের কাছে কিছু গোপন করলে ফ্যাসাদে পড়তে হয়। আমি এখানে এসেছিলাম প্রিয়বন্ধু রবি রে’র স্পাই হয়ে।
স্পাই হয়ে! চারুনয়নার দুই চোখে দেখেছিলাম চকিত চমক। একই রিঅ্যাকশন দেখা গেল কল্পনার লবঙ্গলতিকা দেহসুষমায়। কাঠ হয়ে গেল নিমেষে।
আমি আয়েস করে এক টিপ নস্যি নিলাম। তারপর বললাম, দেখুন। ম্যাডাম, রবি আমার কলেজ ফ্রেণ্ড—যেমন প্রেমচাঁদ। শিক্ষাক্ষেত্রের ফ্রেণ্ডশিপ কখনও যায় না যায় কর্মজীবনে। এখন যা বলব, নিশ্চয় তা অফ দ্য রেকর্ড থাকবে?
ম্যাডাম বললেন, এ ঘরে ভিডিও ক্যামেরা বা টেপরেকর্ডার নেই। ঘরোয়া বৈঠক তো। স্বচ্ছন্দে বলুন।
আমি বললাম, কলকাতার শিল্পমেলা থেকে হিরের ডিম চুরি গেছিল—
হিরের ডিম!
হিরের কুচি বোঝাই অনিক্স পাথরের ডিম। তেহরান, পেশোয়ার থেকে আসত হিরের কুচি-চোরা পথে-খনি থেকে চোরাই হিরে—সেই হিরে পেশোয়ারের পাথর কারিগর ফোঁপরা ডিমে ভরে পাঠাত এমন এমন জায়গায়, যেখানে যেখানে রয়েছে টেররিজমের ঘাঁটি। টাকার বদলে হিরে! টেররিজম যাতে অব্যাহত থাকে।
ঈষৎ চমকালেন পুলিশ পুঙ্গবী—ও ইয়েস, এ রকম একটা ভাসা ভাসা মন্তব্য ‘ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে পড়েছিলাম বটে—
২০০২ সালের মার্চ সংখ্যায়?
তা হবে।… তারপর
ইনফরমেশনটা আমার বন্ধু প্রেমচাঁদের কাছেও ছিল। তার জাল পাতা গোটা পৃথিবী জুড়ে। সে জানত, পেশোয়ারের পাথর ডিম ঘুরে ঘুরে চলে আসবে এইখানে-নাইজেলের কাছে।
কেন?
নাইজেল যে হিরে এক্সপার্ট। হিরের খনির পাহারাদার ছিল। হিরে লোপাট করতে গিয়ে ধরা পড়ে। তাই তার মুখ দাগিয়ে দেওয়া হয় ছ্যাকা দিয়ে।
আই সি…, আই সি…
বদলা নেওয়ার জন্যে এই কারবারে নামে নাইজেল। ধর্মে সে খ্রিষ্টান। কিন্তু টেররিজম চালু রাখতে গেলে ক্যাশ কারেন্সি দরকার। তার দরকার টাকার। হিরে আনিয়ে তা ক্যাশ করে নেওয়া হতো। সে ঘাঁটি গাড়ে এখানকার রিসর্টে…
এক মিনিট। হিমাচল অঞ্চলে যে রমরমা রিসর্ট কারবার চলছে, সেখানেও কি আছে হিরের চোরা কারবার?
সরি ম্যাডাম, এ সব প্রেমচাঁদের সিক্রেট। সেখানে পর্নো ফিল্ম ভোলা হয় ঠিকই, বাকিটা উহ্য।
তাহলে বলুন, আপনি ম্যাডাম রে-চিটনিসের ওপর স্পাইগিরি করতে এলেন কেন?
কলকাতার শিল্পমেলায় হিরে চোর ছিল, সেখানকার একটা সংস্থা। তারা চায়নি সেই হিরে যাক টেররিস্টদের কাছে। সেই সংস্থাকে নিয়োগ করা হয়েছিল রবি রে’র মাধ্যমে। সেই হিরে এখন রবির জিম্মায়। কাস্টডিতে বলতে পারেন, চোরের ওপর বাটপারি করেছিল রবি। পৃথিবীর মানুষের স্বার্থে। তাই মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে তার ছেলেকে কিডন্যাপ করে—ডিম সেই মুক্তিপণ—যা সে হাওয়া। করেছিল কলকাতার শিল্পমেলা থেকে।
সঙ্কুচিত চোখে, যে চোখ এমনিতেই সাইজে ছোট—তাদের আরও ছোট করে, আমার দিকে প্রায় নরুন চোখে চেয়ে রইলেন পুলিশ পুঙ্গবী।
আমি গ্রাহ্য না করে বলে গেলাম, কল্পনা হিরের জগতের মেয়ে। হিরের ওপর তার দুর্নিবার আকর্ষণ। সব মেয়েদেরই থাকে… না, না ম্যাডাম, আপনার যে আছে, তা বলছি না… তবে এই কল্পনার আছে… বলুক, ওর নেই? তাই চুরি করেছিল রবির প্রাণাধিক ছটা হিরে ভর্তি পাথরের ডিম।
কল্পনা যেন পাথর।
আমি চালিয়ে গেলাম, আমার বন্ধু এই রবি রে তামাম দুনিয়ার সবক’টা হিরের খনির সব খবর রাখে, হিরের বাজারগুলোর নাড়িনক্ষত্র নখদর্পণে রাখে, ঘরের বউকেও বেছে নিয়েছে হিরে মাজাঘযার জায়গা থেকে, দুজনেই দু’টুকরো হিরে, হিরে এদের ভালবাসে, এরাও হিরেদের ভালবাসে-আর বিরোধের সূত্রপাত সেই হিরে প্রেম থেকে।