একজন বললে, ইন্দ্রনাথ রুদ্রকে দেখতে পাচ্ছি।
আর একজন বললে, করছে কী?
ঢাল বেয়ে নামছে। গেমস ফ্রীক তুলে দেখছে। বাড়ির দিকে ছুটছে।
এরপর আসবে মা।
মায়ের নাম করতেই আমি ছটফটিয়ে উঠেছিলাম। পরে মাকেও তুলে আনবে নিশ্চয়। ফিতে থেকে দু’হাত টেনে বের করবার চেষ্টা করেছিলাম। এই লোকগুলোকে লাফিয়ে শায়েস্তা করে মাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, পুলিশকে খবর দিতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু আমাকে পোকার মতো পিষে রেখেছিল প্রথম লোকটা। যে আমাকে তুলে এনেছিল। তার গায়ে অসুরের মতো জোর।
গাড়ি থেমেছিল অনেক অনেক পারে…
ড্রাইভ করছিল যে, তার গলার আওয়াজ চোয়াডে। বললে, এবার ফোন করা যাক।
শুনতে পেলাম, দরজা খুলে সে নেমে গেল। ফিরে এল একটু পরেই। বললে, কান ফতে।
ফের স্টার্ট নিল গাড়ি। নেমে গেল ঢাল বেয়ে নিচের দিকে। আবার উঠল এঁকাবেঁকা পথে ঘুরে ঘুরে। ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। রোলিং শাটার তোলবার আওয়াজ শুনলাম। নিশ্চয় গ্যারেজ খুলছে। গাড়ি এগিয়ে গেল। ইঞ্জিন বন্ধ হল। পিছনের দিকে লোলিং শাটার নেমে আসার আওয়াজ শুনলাম।
আমার পায়ের ফিতে খুলে দিল একজন। বললে, আয়।
এই সময়ে টানা হ্যাচড়ায় থলি সরে গেছিল চোখের ওপর থেকে।
দেখলাম, রয়েছি একটা গ্যারেজের মধ্যে। গাড়িটাও দেখলাম। সাদা রঙের ভ্যান গাড়ি। ধুলো বোঝাই। পাশের দিকে নীল রঙে কি যেন লেখা। পড়বার আগেই হ্যাচকা টানে সরিয়ে এনে আমাকে নিয়ে গেল একদিকে।
কর্কশ কণ্ঠে বললে, সামনে সিঁড়ি। পা তোল।
বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে টের পেলাম সিডির ধাপ।
কিন্তু নড়ছি না দেখে আমাকে ঝটকান মেরে কাধে তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে নামিয়ে দেওয়া হল মেঝেতে।
চোখের ওপর থেকে থলি ফের একটু সরে গেছিল। দেখতে পেলাম একটা ফাঁকা ঘর। ছোট্ট। ফার্নিচার-টার্নিচার নেই।
কিন্তু একটা চেয়ার ছিল পিছনে। আমাকে ঠেলে বসিয়ে দিল তাতে।
হেঁড়ে গলা বললে, থলি তোল। ছোঁড়ার মুখটা দেখি।
পিছন থেকে একজন টেনে তুলল থলি। আমি দেখলাম, আমার সামনে দাঁড়িয়ে এক পেল্লায় পুরুষ। খুব ঢ্যাঙা, মাথাটা প্রায় ঠেকছে গ্যারেজের ছাদে। খুব কালো। কপালে, চোখের নিচে, দু’গালে গোল গোল কালচে দাগ-যে ছ্যাকা মেরে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। চামড়া পুড়ে গেছিল। এখন শুকিয়ে গেছে। বীভৎস! মাথায়, গালে, ভুরুতে-কোথাও চুল নেই।
আমি শিউরে উঠেছিলাম। কানেব কাছে একজন বললে—আফ্রিকার কাফ্রি। বদমাইসি করিসনি। কাঁচা খেয়ে নেবে।
কাফ্রি দানোটা চিবিয়ে চিবিয়ে হিন্দিতে বললে, ঢুকিয়ে দাও বাক্সে। সঙ্গে সঙ্গে একজন ফের ফিরে জড়িয়ে দিল আমার দু’পা এক করে। মাথায় তুলে নিয়ে গেল বাইরে—ঠাণ্ডা বাতাসে। তখন নিশ্চয় রাত নেমেছে। শীত কড়া। ঠেলেঠুলে আমাকে ঢুকিয়ে দিল একটা কফিনের মতো প্লাস্টিক বাক্সের ভেতরে। উঠে বসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ধাক্কা মেরে শুইয়ে দিল চিৎ করে। ডালা বন্ধ করে দিল মাথার উপর। বুঝলাম, শূন্যে তুলে নিয়ে যাচ্ছে বাক্কা। তারপর স্পষ্ট টের পেলাম, বাক্স ফেলে দিল কুয়োর মতো একটা গর্তের নিচে। দড়াম করে বাক্স আছড়ে পড়ল নিচে। কী যেন ঝুরঝুর করে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে লাগল বাক্সের ওপর। আমার মুখের ইঞ্চি কয়েক ওপরে বাক্সের ডালার ওপরে। বেড়েই চলল সেই প্রপাত-শব্দ।
গায়ে কাঁটা দিয়েছিল তখনই।
বুঝেছিলাম, জ্যান্ত কবর দিচ্ছে আমাকে।