আমি জবাব দিলাম না। দিতে পারলাম না। ডানা মেলে উড়ে যায় না একটা মানুষ। হনুমানের মতো লাফ দিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে যায় না। সোমনাথের পায়ের ছাপ কিন্তু আচমকা আর নেই। জমির দিকে নজর রেখে তিন-চার গজ দূরে এসে থমকে দাঁড়ালাম।
মাটিতে জাগ্রত রয়েছে অস্পষ্ট পাদুকাচিহ্ন।
এই জুতোর গোড়ালি বড়। সোমনাথের জুতোর গোড়ালির চাইতে বড়।
হেঁট হলাম গোড়ালির পিছনে। জুতোর ডগা যেদিকে ফিরে থাকা উচিত, তাকালাম সেদিকে। ডগা ফিরে রয়েছে সোমনাথের শেষ পদচিহ্ন যেখানে রয়েছে, সেইদিকে।
সোমনাথ-পদচিহ্নকে কেন্দ্রবিন্দু করে একটা চক্কর মারলাম—বড় গোড়ালিওলা জুতোকে দিয়ে মনে মনে একটা বৃত্ত ভেবে নিয়ে।
কিন্তু নেই। নেই আর কোনও ফুটপ্রিন্ট। অথচ থাকা উচিত ছিল। বড় গোড়ালির ছাপ পড়েছে আধখানা। তারপর আর কিছু নেই। পুরো জুতোর ছাপ তো নেই-ই গোড়ালির ছাপটাও পুরো পড়েনি। কিন্তু পয়েন্টিং করে রয়েছে সোমনাথের জুতোর ছাপের দিকে।
মনে মনে কল্পনা করে নিলাম ঘটনা-দৃশ্য। কল্পনা দিয়ে বানিয়ে নিলাম কী কী ঘটেছিল, কেমনভাবে ঘটেছিল। এমন ঠাণ্ডাতেও মনে হল, বুঝি ঘামছি।
এদিকের এই পাহাড়ি ঢলে শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে রাশি রাশি। ঢাল বেয়ে পা টিপে টিপে জান্তব চরণে উঠে এসেছে একটা লোক। ঝোপের আড়ালে আড়ালে উঠেছে, শুকনো পাতা মাড়িয়ে মাড়িয়ে উঠেছে, অথচ বনচর শিকারি পশুর মতো পায়ের শব্দ জাগ্রত করেনি এতটুকু। তাই কিছু শুনতে পায়নি সোমনাথ। শুকনো পাতা আর ভাঙা ডাল মাড়িয়ে এইভাবে নিঃশব্দ চরণে আসতে পারে শুধু বনের মাংসাশী শিকারি বেড়াল জাতীয় প্রাণি। ঝোপ ভেদ করে সেই মানুষ-বনচর সোমনাথকে দেখতে পায়নি—কিন্তু তার গেমস ফ্রিকের আওয়াজ শুধু কানে শুনে উঠে এসেছে ঢাল বেয়ে একটু একটু করে। তারপর প্যান্থার লম্ফ মেরে দশ বছরের ছেলেটাকে তুলে নিয়ে গেছে এমনই বিদ্যুৎসম ক্ষিপ্রতায় যা চোখে না দেখলে প্রত্যয় হবে না। চেঁচানোর সুযোগটুকুও দেয়নি সোমনাথকে। এইভাবে যারা মানুষ গায়েব করে, তারা জানে, আগে খপ করে কীভাবে মুখ বন্ধ করতে হয়, সঙ্গে সঙ্গে শূন্যপথে বড়ি তুলে নিয়ে যেতে হয়।
কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিলাম চারদিকে। দশ ফুট দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না।
সোমনাথও দেখতে পায়নি দশ ফুট দূরের ঝোপের মধ্যে গা ঢেকে ওত পেতে থাকা আততায়ীকে।
গলা শুকিয়ে এসেছিল আমার কিডন্যাপিং সিনটা কল্পনা করতে গিয়ে! পুলিশ পুঙ্গবী একদৃষ্টে চেয়েছিলেন আমার ভাবনা-ক্লিষ্ট চোখের দিকে।
এখন বললেন খুব আস্তে, আপনি ধোঁকায় পড়েছেন? চোখে ধোঁয়া দেখছেন?
হয়তো কণ্ঠস্বরে কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গের প্রলেপ ছিল। কিন্তু আমি তা গায়ে মাখিনি। শুকনো গলায় বলেছিলাম, ম্যাডাম, এ কাজ যে করেছে, তার কমব্যাট এক্সিপিরিয়েন্স আছে।
দ্বন্দ্বযুদ্ধে ওস্তাদ?
ইয়েস, ম্যাডাম। শিকারি জন্তুর মতো পেছন নিতে পারে, ছোঁ মেরে শিকারকে তুলে নিয়ে যেতে পারে, দশ ফুট লাফিয়ে আসে উড়ন্ত পাখির মতো, চেঁচানোর সুযোগ দেয় না, টুটি টিপে ধরে, মুখ বন্ধ করে দিয়ে।
যেন গা হিম হয়ে গেল ম্যাডাম পুলিশের, অন্তত মুখ দেখে তাই মনে হয়েছিল আমার। অথচ পাহাড়ের মেয়ে তিনি, বিলক্ষণ ডাকাবুকো।
কিন্তু মানুষ-শিকারি নন। সোমনাথকে যে নিয়ে গেছে, সে পোক্ত ম্যান-হান্টার। এই পাহাড়ে সে ঘাপটি মেরে নজর রেখেছে আমাকে আর সোমনাথকে বেশ কয়েকদিন ধরে। মুখস্থ করেছে দু’জনের সমস্ত গতিবিধি। কোথায় হাঁটি, কোথায় দাঁড়াই-সমস্ত। সে জানত আমি কোথায় থাকি, সোমনাথ কোথায় থাকে, আর তার মা এখন কাছে নেই। নজরে নজরে রেখেছিল বলেই জেনেছিল কখন একা-একা বেরিয়ে গেল সোমনাথ। ছোঁ মেরেছে ঠিক তখনই।
এ হেন লোকেদের অসাধ্য কিছু নেই। এর জন্যে দরকার স্পেশ্যাল ট্রেনিং। যে ট্রেনিং আছে আমারও।