তারপর? ‘ উধাও হয়ে গেল হিরের ডিম।
তারপর? ‘ উধাও হয়ে গেল হিরের ডিম।
ইন্দ্র, আমি বুঝতে পারছি, তোর হিরে-চোখের চাঞ্চল্য দেখে টের পাচ্ছি, তুই অধৈর্য হচ্ছিস। কিন্তু হে বন্ধু, আমার মুখের আগল যখন খুলে যায়, তখন যে। উনপঞ্চাশ পবনের ধাক্কায় ফুলে ওঠে মনবজরার পাল। সুখ-দুঃখের এলোমেলো। ভিড়ের কথা উপছে ওঠে মনের মতো দোস্তের কাছেই। এই জীবনের গিরিপথের নানা পাথর-নুড়ির মধ্যে আচমকা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম একটা হিরে। সে আমার কল্পনা… সে আমার কল্পনা… পাহাড়ের মেয়ে কল্পনা… আশ্চর্য এক পাথরে গড়া তার মন… কখনও কোমল… কখনও কঠিন…
আমি যেন কি রকম হয়ে গেছিলাম তার সবুজ পাথর চোখ… অথচ পাথরের মতো নিষ্প্রাণ নয় সেই চোখ… যেন সবুজ আকাশ… অন্য এক গ্রহের অন্য এক আকাশ… সবুজ… সবুজ… সবুজ…।
আমার মোহাবিষ্ট চোখ দেখে মৃদু হেসে জহুরি দণ্ডপথ বেশ কিছু উপদেশ মন্ত্র আমার কানের মধ্যে ঢেলে দিয়েছিলেন। জাত জহুরি তো… পাথর দেখে চেনেন… মানুষ দেখে বোঝেন… বিশেষ করে মেয়েমানুষ…
হাজারো কথার মধ্যে একটা ব্যাপার আমার মাথার মধ্যে কথার পেরেক ঠুকে ঠুকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাপুহে, হিরে যখন তোমাকে টেনেছে, ওষুধের কারবারে থেকেও হিরের কারবার নিয়ে মেতেছ, তখন একটা ব্যাপার সদা জাগ্রত রাখবে তোমার মনের পটে। ব্যাপারটা মানব মনের মূল প্রকৃতি নিয়ে—হিরের টান এড়াতে পারে না। হিরে একটা ক্রিস্টাল প্রহেলিকা… ভাগ্যবিধাতার সেরা সম্পদ। প্রচ্ছন্ন থাকে হিরের ক্রিস্টাল দুর্গে… হিরে হাতে নিয়ে তাই হাতছাড়া করতে চায় না কোনও মানুষ… রাখতে চায়… সঙ্গে সঙ্গে… হিরের মন্ত্রশক্তি যেন ঘুরিয়ে দেয় তার ভাগ্যচক্র… মনোরথ ধেয়ে যায় চক্রনির্দিষ্ট বিজয় পথে…
ইন্দ্র, জহুরির এত কথার কাব্য আমার মাথায় ঢোকেনি। আমি চিরকাল নীরস, কাঠখোট্টা। তাই পষ্টাপষ্টি জানতে চেয়েছিলাম, হিরের আবার মন্ত্রশক্তি কি? হিরে তো একটা পাথর।
চোখ নাচিয়ে হাস্য করেছিলেন জহুরি দণ্ডপথ। অট্টহাস্য নয়, মৃদু হাস্য। যাকে কবি-বিরা বলে স্মিতহাসি! বৃদ্ধের কেউ নেই। না পুত্র, না কন্যা, না ঘরণী। হিরে ছাড়া তাঁর দুনিয়ায় আর কিছু নেই। আমাকে তার হিরে চোখ দিয়ে দেখেছিলেন, হিরে চোখ দিয়ে মেপেছিলেন, হিরে চোখ দিয়ে কাছে টেনেছিলেন, হিরে চোখ দিয়ে বিশ্বাস করেছিলেন।
তাই, ইন্দ্রনাথ, অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্যি, হিরের গুপ্ত শক্তিব গোপন মন্ত্র অর্পণ করে গেছিলেন শুধু আমাকেই। হয়তো… না, না, হয়তো কেন, উনি নিশ্চিতভাবে জানতেন ওঁর শেযদিন আর দূরে নেই, তাই মন্ত্রশক্তির মহাকথা বলে গেছিলেন শুধু আমাকে…
জেনেছিলেন তিব্বতের যে পর্বত কন্দর থেকে, যে গুম্ফার গায়ে পাথরে আকীর্ণ সংস্কৃত মন্ত্ৰশ্লোক থেকে, সেই গুম্ফা এখন পৃথিবীর জঠরে।
তিব্বত যে গুটিয়ে যাচ্ছে… সরে যাচ্ছে এশিয়ার দিকে… বছরে বত্রিশ মিলিমিটার হিসেবে… সরছে ইণ্ডিয়ান প্লেট–গ্লোবাল পজিসনিং স্যাটেলাইটের হিসেবে…
অন্য কথায় চলে যাচ্ছি… বিজ্ঞানের কথা এখন থাক… আসুক অপবিজ্ঞান … যুক্তি বিজ্ঞানের ধ্বজা তুলে যারা পাড়া মাতাচ্ছে… অপবিজ্ঞান শব্দটা তাদের কাছ থেকে ধার করে এনে তো শোনালাম। যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই, তা তো অপবিজ্ঞান। হোক… মন্ত্র রচনার যুগে জন্ম হয়নি যে হিরে পাথরেব, অযুত নিযুত শক্তি। আধার সেই হিরে পাথরের শক্তিকে জাগ্রত করা যায় যে মন্ত্রশক্তি দিয়ে, জনি। দণ্ডপথ আমাকে তা শিখিয়ে দিয়ে গেছিলেন… তারপর আচমকা দেহ রেখেছিলো।
রসময় রহস্যের সে কথা আসবে পারে। এখন শোনা হিরেকে জাগাতে হয় কী করে। কিন্তু, হে বন্ধু, এ কথা যেন পাঁচকান না হয়, তত্ত্ববিজ্ঞানীরা… যাকে তোরা বলিস অকাল্টসায়েন্টিস্ট … পরাবিজ্ঞানী… তারা কিন্তু লাফিয়ে উঠেছিলেন, হীরক শক্তি জাগরণের পন্থা-প্রকরণ জানবার জন্যে আমার পেছনে আঠার মতো লেগেছিল… কাউকে বলিনি… কাউকে বলিনি… সবাই তো অব ইন্দ্রনাথ রুদ্র নয় সে যে একটা সচল সিন্দুক!
ইন্দ্র, সুনামির বিধ্বংসী ক্ষমতার আভাস কিন্তু টের পেয়েছিল মনুষ্যেতর প্রাণিরাতাদের দৌলতেই আন্দামানের অনুন্নত মানুষবা কেউ মরেনি। পালিয়ে বেঁচেছিল। তাহলে তো দেখাই যাচ্ছে, অত্যুন্নত মানুষ যন্ত্রবিজ্ঞানের দৌলতে যে প্রলয়ঙ্কর। শক্তির পূর্বাভাস ধরতে পারে না, জীবজন্তু প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতায় তা জেনে ফেলে।
তাহলে, অদৃশ্য জগতে এমন কিছু আছে, যা আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্যশালায় এখনও ঠাঁই পায়নি… কিন্তু আছে, আছে, সেই সব শক্তি বিলক্ষণ বিদ্যমান রয়েছে… জেনেছে পরাবিজ্ঞান… প্রাচীন বিজ্ঞান… গুপ্ত বিজ্ঞান… গুহ্য থেকে গেছে সেকালের তত্ত্ববিজ্ঞানীদের গোপনীয়তার দরুন।
এই ব্যাপারটা নিয়েই প্রথমে একটা ছোটখাটো লেস্টার দিয়েছিলেন জহুরি দণ্ডপথ। আমি আধুনিক বিজ্ঞানের যৎকিঞ্চিৎ জানি, তাই অল্পবিদ্যার দৌড় দেখাতে যাইনি। জানি বলে যে-জন করে অভিমান, কিছুই জানেনি তারা, জেনেছে যে-জন সেজন জানিবে হয়েছে বাক্যহারা। আমি যে একটা নাথিং, এই জ্ঞান যার থেকে, সে কিন্তু সামথিং জানতে পারে। যে বলে আমি জানি এভরিথিং, সে একটা নট, মানে, জিরো।
তোর অসীম ধৈর্যের তারিফ না করে পারছি না, ইন্দ্র। আমার এত বকুনি যে একটা মস্ত আশ্চর্য বিষয়ের গৌরচন্দ্রিকা, তা তুই তোর মিনিশন, আই মিন, পূর্বাভাস-জ্ঞান দিয়ে উপলব্ধি করেছিস।
© 2023 BnBoi - All Right Reserved
© 2023 BnBoi - All Right Reserved