বালাজি যার ধ্যান-জ্ঞান… শয়নে স্বপনে যে শুধু বালাজি নিয়েই ভাবে আর পাঁচজনকে ভাবায়, সে যে তার কালো চোখের বিদ্যুৎ দিয়ে আমার ভেতর পর্যন্ত তোলপাড় করে দেবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! হিরে নিয়ে তড়বড়িয়ে কথা বলতে গিয়ে হয়তো একটু বাড়িয়েই বলেছিল… তা বলুক… আমি তো ক্রিমটুকু তুলে নিয়েছিলাম ওর ফেনাময় কথার স্রোতের মধ্যে থেকে…
বালাজি কালো পাথরে বিগ্রহ হতে পারে, কিন্তু বড় সঞ্জীব বিগ্রহ, পাথর দিয়ে গড়া বলেই বোধহয় তিনি পছন্দ করেন পৃথিবী গ্রহের সেরা পাথর… হিরে পছন্দটা এমনই প্রবল যে ভক্তের আঙুল থেকে হিরের আংটি পর্যন্ত ছিনিয়ে নেন।
আমি এই পর্যন্ত শুনে তাজ্জব হয়ে গিয়ে বলে ফেলেছিলাম, সে কী! পাথরের বিগ্রহ কি রক্তমাংসময় আঙুল থেকে আংটি কেড়ে নিতে পারে?
নন্দিতা বলেছিল, ঠিক এই রকম আপাত অসম্ভব ব্যাপারটাই যে ঘটে গেছিল একদিন।
আমি বলেছিলাম, বালাজি বেদি থেকে নেমে, ভক্তের আঙুল থেকে আংটি খুলে নিয়ে নিজের আঙুলে পরে, ফের বেদিতে উঠে গিয়ে বসে পড়েছিলেন?
তা কেন? তা কেন? মুখর হয়ে উঠেছিল আবলুস মেয়ে নন্দিতা কৃষ্ণা-ভক্ত এক সময়ে বালাজির সামনে এসে কথা দিয়ে গেছিল, তার অমুক মনোবাঞ্ছা যদি পূর্ণ হয়, তাহলে আঙুলের এই ঝকমকে মস্ত হিরের আংটি দিয়ে যাবে বালাজিকে।
ঘুষ?
প্লীজ, রসিকতা নয় বালাজিকে নিয়ে। মানৎ করলে তা দিতে হয়, হিন্দুধর্মের রেওয়াজ। বালাজি ভক্তের ইচ্ছে মিটিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ইচ্ছাপূরণের শক্তি দিয়ে… ভক্ত কিন্তু কথা রাখেনি… আংটিটা আঙুলে পরে এসে যখন জোড় হাতে প্রণাম করে, আংটি আঙুলে রেখেই, সরে পড়তে যাচ্ছে… তখনই ঘটে গেল অলৌকিক কাণ্ডটা।
আঙুল থেকে আংটি খুলে বেরিয়ে গেল?
আজ্ঞে। হাওয়ায় উড়ে গিয়ে ছিটকে পড়ল… বলুন তো কোথায়?
বালাজির চরণতলে?
প্রণামী নেওয়ার থলিতে।
অদৃশ্য শক্তির টানে?
আজ্ঞে।
এমনও তো হতে পারে, আমি ধীরে সুস্থে বলেছিলাম—পুরো ব্যাপারটাই রটনা।
রটনা! কথাটার অর্থ?
অতীব সরল। মানৎ করা আংটি আঙুল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পাণ্ডারা ফেলে দিয়েছিল প্রণামীর থলিতে।
তিরুপতির মন্দিরে পাণ্ডারা গুণ্ডা নয়, সব্বাই তা জানে।
আমি আর কথা বাড়াইনি। হিরে প্রসঙ্গে চলে গেছিলাম। নন্দিতার মুখ থেকেই শুনেছিলাম, তিরুপতির রত্নগর্ভে সঞ্চিত হয়ে এসেছে অমূল্য অনেক হিরে সুদূর অতীতকাল থেকে ইণ্ডিয়া যখন ছিল ডায়মণ্ডের একমাত্র উৎস—এই পৃথিবীতে। দক্ষিণ ভারতের বহু রাজ্যের উত্থান আর পতন ঘটেছে এই হিরে সম্পদকে কেন্দ্র করে। সাম্রাজ্য শক্তি বাড়িয়েছে, শক্তি হারিয়ে ধুলোয় বিলীন হয়েছে—মূলে রয়েছে খনি থেকে উঠে আসা হিরে। যত হিরে উপহার দিয়েছে খনি, তার বেশির ভাগ গেছে তিরুপতি আর অন্য অন্য মন্দিরে—ভক্ত শাসকদের প্রণামী হিসেবে। বিগ্রহদের তুষ্ট রাখবার পর নৃপতিরা নিজেদেরকে হিরে দিয়ে সাজিয়েছে নর-দেবতা হওয়ার অভিলাষে। হিরে এনে দিয়েছে দেব-দ্যুতি, মুগ্ধ থেকেছে প্রজারা। ইউরোপের দূর দুর অঞ্চল থেকে পর্যটকরা এসেছে, রাজসভায় হিরের ছড়াছড়ি দেখে হতভম্ব হয়ে ফিরে গিয়ে সেই গল্প শুনিয়েছে স্বদেশে। হিরে, হিরে, হিরে-হিরেময় দেশ এই ভারতবর্ষ। যোড়শ শতাব্দীতে এমন এক পর্যটকের আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেছিল বিজয়নগরের রাজার ঘোড়র গায়ে হিরের সাজ দেখে। এত হিরে দিয়ে তো একটা মস্ত শহর মুড়ে দেওয়া যায়!
হায়দ্রাবাদের প্রান্তে পাহাড়ের ওপর রয়েছে গোলকোণ্ডার রাজাদের কেল্লা প্রাসাদ। তিনশো বছর আগে সেই প্রাসাদ লুঠ করে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে মোগল লুঠেরা-রা। পরিত্যক্ত সেই প্রাসাদ এখন চিল আর মাছরাঙাদের রাজত্ব। তাদের কলরবেই মুখর হয়ে থাকে একদা বিপুল ঐশ্বর্যের কেন্দ্র-আর জেগে থাকে অশ্রুত দীর্ঘশ্বাস-হিরে নিয়ে যারা একদা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল—এই দীর্ঘশ্বাস সেই বিদেহীদের।
ভারতবর্ষের সবচেয়ে নামজাদা হীরক রাজত্ব ছিল এই গোলকোণ্ডায়। এত বছর পনেও হিরে-ঐশ্বর্য নিয়ে কথা বলতে গেলেই গোলকোণ্ডার নাম এসে যায়। সম্পদ আর গোলকোণ্ডা-সমার্থক হয়ে এখানকার হিরে বর্ষণ করেছে রক্তাক্ত অভিশাপ। কোহিনুর, হোপ ডায়মণ্ড, রিজেন্ট-ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই হিরদের প্রথম আবির্ভাব তো গোলকোণ্ডায়, এ ছাড়াও আরও অনেক চোখ ধাঁধানো হিরে এই গোলকোণ্ডা থেকে বেরিয়ে এদেশে বিদেশে রক্তঝরানো অনেক নাটকের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা… এই রক্তলোভী হিরেরা… এদেশ থেকে গেছে ভারতবর্ষের বাইরে হাত বদল হতে হতে… বিক্রি, উপটৌকন, উৎকোচ, চুরি, লুঠ। আজও ইণ্ডিয়ার বহু পুরোনো বড়লোকের প্রাসাদে পাওয়া যাবে এমন সব হিবে, যাদের কাটাই করা হয়েছে সেকেলে পন্থায়—যে কাটিং পদ্ধতির মডার্ন অনুকরণ আজকের। হিরেদের গায়ে দেখতে পাওয়া যায়। হিরে কাটিংয়ের এহেন অভিনবত্ব থেকে। আঁচ করে নেওয়া যায়, কি পর্যায়ে পোঁচেছিল হীরক সমৃদ্ধ ইণ্ডিয়ার হিরে কারিগরেরা।
আজ তারা নেই। ইন্দ্র, ভাগ্যের বিপুল পরিহাসে চাকাও ঘুরে গেছে। ইণ্ডিয়ার হিরে-খনিগুলোয় হিরে ফুরিয়ে যাওয়ার অনেক… অনেক বছর পরে… গোলকোণ্ডার শেষ হিরে কারবারি গোলাকোণ্ডা ছেড়ে চলে যাওয়ার বহু… বহু বছর পরে… বিশ্বের হিরের। ফের এই ভারত দিয়েই যাচ্ছে আর আসছে।
ইন্দ্র, তুই কি ধৈর্য হারাচ্ছিস? হিরে নিয়ে বেশি ফেনিয়ে যাচ্ছি? আমি নিরুপায় ইন্দ্র, আমি নিরুপায়। “হিরে এমনই একটা পাথর যার মধ্যে আছে একটা সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার… হিরে নিয়ে কথা শুরু করলে তাই তো তা শেষ করা যায়