ইন্দ্র, কল্পনার চোখের চাহনির মধ্যে সত্যিই অসাধারণ কিছু আছে। এাটক যোগ কী বিদ্যা জানতে চেয়েছিলাম। হেসে গড়িয়ে পড়ে কল্পনা বলেছিল, সেকালের মুনিঋষিরা বনের পশুদেরও বশে রাখত মনের যে শক্তি দিয়ে…চোখের যে চাহনি দিয়ে…ত্রাটক যোগ অভ্যেসে তা এসে যায়। আমার অসমিয়া মা আমাকে তাই শিখিয়েছে…তাই তোমার মতো বুনো আমার চোখের টানে বাধা পড়েছ…প্রিয়তম রবি, তুমিই এখন সূর্য আমার এই জগতে, আমি তোমার গ্রহ…
আমি বলেছিলাম, গ্রহ না, গ্রহণী।
কল্পনার বাংলা জ্ঞান তেমন উত্তম নয়। জাদু চোখ নাচিয়ে বলেছিল, তা তো বটেই…তা তো বটেই…মেয়ে গ্রহরা তো গ্রহণীই হবে।
বেচারা কল্পনা! ঠাট্টাও বোঝেনি। আমিও বোঝাইনি। গ্ৰহণী যে একটা উদরাময় রোগ, ক্ষুদ্রান্ত্রের ব্যায়রাম, তা ও জানবে কী করে? আমি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, শারীরস্থান রপ্ত করেছি…আমি জানি।
এই পর্যন্ত শুনে, কল্পনা-সঙ্গীত শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে আমি, শ্রী ইন্দ্রনাথ রুদ্র বলেছিলাম, কী মুশকিল! হচ্ছিল হিরে কাহিনি, চলে এল খণ্ডকাব্যকল্পনা…কল্পনা…কল্পনা!
তখন কি জানতাম, খণ্ডপ্রলয়ের আভাস পেয়েছিলাম সব কিছুর নিয়ামক নিয়তির নিয়মে!
কল্পনার ইস্পাহানি চোখ আর নাক-ঠোঁটের বাঙালিয়ানা মাদকতা প্রসঙ্গে আসবো পরে। কঠিন ঠাঁই এই ইন্দ্রনাথ রুদ্র যে অনেক গভীর জলের মাছ… আরাবল্লী-বিদ্যাধরী-গন্ধর্ব কন্যারাও বঁড়শিতে গাঁথতে পারেনি যাকে…সে ছিল কি মতলবে?
ইন্দ্রনাথ রুদ্র যখন মতলববাজ হয়, তখন সে রূপময় পাঁকাল!
কিন্তু কল্পনা যে আমার কলমে ভর করেছে। ঘুরে ফিরে কল্পনা কাহিনি চলে আসছে কলমের ডগায়! ওর ওই চোখ আর নাক-ঠোঁট-চিবুকের গঠনের মধ্যে যে জাদুকরী মিশেল আছে, তা আমার রহস্যসন্ধানী চক্ষু যুগলের মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কের মধ্যে ঔৎসুক্য সঞ্চার করে গেছে বরাবর। আমি মানব প্রত্নবিদ নই, তবে সাংস্কৃতিক নৃবিদ্যা নিয়ে মস্তিষ্কচর্চা না করে পারি না মানুষের মুখ, করোটি আর শরীরের গঠন দেখলেই! তাই কল্পনার চোখ নাক চিবুক হনু আমার মনে ঔৎসুক্য জাগিয়েছিল। যার মুখাকৃতির মধ্যে বংশছবি বিধৃত রয়েছে এরকমভাবে, তার পদবি চিটনিস কেন?
চিটনিস তো ষোলআনা সিকিমি পদবি। তাহলে?
আমার গোয়েন্দা কৌতূহল মিটিয়ে দিয়েছিল কল্পনা নিজেই। ওর বাবা ইস্পাহানি যাযাবর, মা অসমিয়া—কামরূপ কন্যা। বিয়ে-থা করে নিবাস রচনা করেছিল সিকিমে; কিন্তু পদবি পাল্টে নিয়েছিল। কেউ কারও পদবীকে প্রাধান্য দেয়নি। নতুন রূপের নতুন মানুষ এই কন্যা মিশে যাক সিকিমি সংস্কৃতিতে। তবে, রক্তে বহন করুক ইস্পাহানি উদ্দামতা আর কামরূপী ছলনা…ললনাদের যা সহজাত।
ঘুরে ফিরে কল্পনা প্রসঙ্গ চলে আসছে কাহিনির মধ্যে। সব সঙ্গীতের মূল সুর যেমন একটাই থাকে, বিষম বিচিত্র এই কাহিনির মূল সুরও যে কল্পনা। হিরের ফ্রমে বাঁধানো একটা ছবি-কল্পনা যার নাম। সুন্দরী, তুমি শুকতারা!
কিন্তু আমার মাথায় কালাহারি মরুভূমিতে হিরের খোঁজে যাওয়ার কাহিনি-বীজ বপন করে দিয়েই উদ্দাম গুরের সেই অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি যেন ঘোরের মাথায় বলে গেছিল বন্ধুবর রবি রে।
ফিকে সবুজ পাথরের পাহাড় উঁচিয়ে দু’পাশে! মাঝে কঙ্কর-আকীর্ণ পথ। যদিও পথ তাকে বলা যায় না। নেচে নেচে ট্রাক চলেছে এই পথে। খনিজ সম্পদের ম্যানেজার মহাভি রয়েছে রবির সঙ্গে। ট্রাক ঢুকছে বিবর পথে—চলেছে বিবরের একদম তলার দিকে। এই বিবরেরনাম জবানেঙ্গ-কালাহারি মরুভূমির বোটসওয়ানা অঞ্চলের একদম শেষের অঞ্চল। হিরের খনি রয়েছে এইখানেই। ধরণীর সবচেয়ে রমণীয় ভূ-সম্পত্তি এই অঞ্চল। ধূসর মরু তার ভয়াবহতা দিয়ে আগলে রেখেছিল হাজার হাজার বছর ধরে। এখন তার গোপন দ্বার দু’হাট হয়ে গেছে হিরে-সন্ধানীদের উৎপাতে।
কিমবারলাইট ঠাসা একটা শিরা পাওয়া গেছিল এখানে ১৯৭৩ সালে। পাইয়ে দিয়েছিল ধরণীর নিকৃষ্টতম এক পোকা। উইপোকা।